শ্রীলঙ্কায় প্রবল জনবিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। তবে এখনও প্রেসিডেন্টের পদ ধরে রেখেছেন মাহিন্দার ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে। গোতাবায়ার পদত্যাগের দাবিও জোরালো হচ্ছে দ্বীপরাষ্ট্রটিতে। চীনঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত রাজাপাকসে পরিবার গত কয়েক মাসে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টায় ছিল। তবে এর পরও অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামাল দেয়া যায়নি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলেছে, রাজাপাকসে পরিবার নিজেদের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে এনেছে। ভারত ভালো করেই জানে এমন অবস্থায় কোনো বিশেষ সরকারকে নয়, সহায়তা করতে হবে শ্রীলঙ্কাকে। প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করেছেন এমি জান্নাত।
শ্রীলঙ্কায় ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে সোমবার পদত্যাগ করেছেন। রাজাপাকসের সমর্থকরা কলম্বোয় তার বাসভবনের বাইরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হওয়ার পর তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন। বিক্ষোভের ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের এমপিসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। প্রতিশোধপরায়ণ বিক্ষোভকারীরা রাজাপাকসের পৈতৃক বাড়িসহ বেশ কয়েকটি ভবনে আগুন দেয়।
রাতারাতি বিক্ষোভের মাত্রা বাড়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ত্রিনকোমালির একটি নৌঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। মাহিন্দার ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন, তবে সেটা কতদিন তা স্পষ্ট নয়।
মাহিন্দার এই পদত্যাগের লক্ষ্য ছিল অসম্মানজনক রাজনৈতিক পরাজয় এড়ানো। এর আগে বিক্ষোভ প্রশমনে মাহিন্দার ছেলে ক্রীড়ামন্ত্রী নামাল রাজাপাকসে, ভাই অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে এবং কৃষিমন্ত্রী চমাল রাজাপাকসে মাসখানেক আগে পদত্যাগ করেন। তবে এর পরও বিক্ষোভ থামার লক্ষণ নেই, বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য এবার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পতন।
এর মানে কি শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের দিন শেষ হয়ে আসছে? যে পরিবারটি ৫০ বছর ধরে দ্বীপরাষ্ট্রের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত, তাদের শেষ অধ্যায়টি কি বড়ই অন্ধকারাচ্ছন্ন?
ভূরাজনীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার
এখানে দুটি প্রশ্ন উঠে এসেছে। প্রথমটি ভূরাজনীতিতে বন্ধুত্ব, জোট, শত্রুতা এবং কৌশলগত স্বার্থের বিষয়, যেখানে বলা হয়, ‘স্বার্থের বাইরে কোনো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই।’ গত কয়েক দশকে ভারত-শ্রীলঙ্কা সম্পর্ককে এর মাধ্যমে সুন্দরভাবে চিত্রিত করা যায়।
২০০৫-১৫ সাল পর্যন্ত যে দশকে মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে 'স্থিতিশীল কিন্তু শীতল’ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এ সময়েই তিনি চীনাদের আরও কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। তিনি চীনকে হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর তৈরি করতে বলেছিলেন, যা পরে পরিচালনার জন্য একটি চীনা কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তবে ২০১৯ সালে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসেন, আর ভাই গোতাবায়া হন প্রেসিডেন্ট, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মাহিন্দার সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় নামেন। ভারত জানত, শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক মাত্রায় প্রভাব হারানো বিরোধী দলের কারণে তার সামনে বিকল্প তেমন নেই। মোদির এই প্রচেষ্টা পরে অনেক ফল দিয়েছে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি ক্ষমতা ভাগাভাগি করার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এটি গুরুতর খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করে যখন ভাড়াভাগিটা কেবল পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই হয়। সবারই জানা, রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের বিষয়টি দক্ষিণ এশিয়াজুড়েই বিস্তৃত, তাহলে শ্রীলঙ্কা কেন এর ব্যতিক্রম হবে?
তবে যখন রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকাররা তাদের প্রাপ্যের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ভোগ করে এবং জাতিগত বিভেদকে জোরদার করলে জটিলতা বাড়বেই। রাজাপাকসেরা গত কয়েক বছরে এটাই করেছেন। বন্দরনায়েকে-কুমারতুঙ্গারাও অতীতে এটা করেছেন, কিন্তু সেখান থেকে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বন্ধন দৃঢ় করতে রাজাপাকসেরা কী শিক্ষা নিয়েছেন?
রাজাপাকসের অবক্ষয়
শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসেদের বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভের শুরু নিঃসন্দেহে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট থেকে। যে সংকটের ফলে তীব্র খাদ্যসংকট, জ্বালানি ও ওষুধের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ ৫ কোটি ডলারের নিচে নেমে গেছে এবং দেশটি কিছু বৈদেশিক ঋণের মাসিক কিস্তি পরিশোধের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে হাত পেতেছে। এই প্রচেষ্টাকে সহায়তা দিয়েছে ভারত।
তবে সিংহলি ও তামিল সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্তর্নিহিত বিভেদকে আরও উসকে দিয়েছেন রাজাপাকসেরা। এলটিটিইর পরাজয়ের মাধ্যমে ২০০৯ সালে শেষ হওয়া গৃহযুদ্ধের সময় গোতাবায়া ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আর মাহিন্দা ছিলেন প্রেসিডেন্ট। ভারত সে সময় রাজাপাকসেদের সমর্থন করেছিল, কারণ এলটিটিই এক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে (রাজীব গান্ধী) হত্যা করেছিল। মাহিন্দা সে সময় ১৩তম সংশোধনী কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যা ছিল ১৯৮৭ সালের ভারত-শ্রীলঙ্কা চুক্তির অংশ। এতে তামিল সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসহ সব প্রদেশকে নিজস্ব ভূমি ব্যবস্থাপনা ও পুলিশি ক্ষমতা দেয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কিন্তু মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। তিনি এবং তার ভাই সিংহলি জাতীয়তাবাদী বাঘের পিঠে চড়েছিলেন। এলটিটিই নেতা প্রভাকরণকে তার ১২ বছরের ছেলসহ হত্যা করা হয়। এলটিটিইকে পরাস্ত করা হয়েছিল এবং প্রায় ৩০ বছরের দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানো হয়েছিল।
এরপর মনমোহন সিং থেকে মোদি পর্যন্ত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীরা এসেছেন, কিন্তু রাজাপাকসেরা নমনীয় হননি। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি কার্ডের আশ্রয় নিয়েছিলেন, ক্ষমতাধর ও উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধভিক্ষুরাও যার অন্তর্ভুক্ত (অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বৌদ্ধভিক্ষুরাও এখন রাজাপাকসেদের বিরোধী)। তারা নিজেদের ক্ষমতা চীরস্থায়ী করতে চেয়েছিলেন।
২০০৫ সাল থেকে গোতাবায়া অথবা মাহিন্দা শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মাঝখানে অবশ্য ২০১৫ সাল থেকে চার বছরের জন্য বিস্ময়করভাবে মাইথ্রিপালা সিরিসেনা এই পদে আসেন, বলা হয়ে থাকে তিনি ভারতের গোপন সমর্থনপুষ্ট ছিলেন।
২০০৫ সালে যখন মাহিন্দা প্রেসিডেন্ট হয়ে সংবিধানে ১৮তম সংশোধনী আনেন। এর ফলে একজনের সর্বোচ্চ দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে না পারার বাধা অপসারিত হয়। ২০১৫ সালে যখন মাইথ্রিপালা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ১৯তম সংশোধনীর মাধ্যমে ফের সেই দুই মেয়াদের সীমা ফিরিয়ে আনেন। তবে ২০১৯ সালে গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট হয়ে ২০তম সংশোধনীর মাধ্যমে সীমাটি আবার সরিয়ে দেন।
শ্রীলঙ্কার বিভাজিত রাজনীতির সমস্যাটি হলো প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর জুটি অত্যন্ত শক্তিশালী। সবচেয়ে খারাপ দিকটি হলো, বিরোধী দল কোনো ভূমিকা নিতে অস্বীকার করছে। সামাগি জন বালাওয়েগায়া (এসজেবি) দলের নেতৃত্ব দেয়া সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রেমাদাসার ছেলে সজিথ প্রেমাদাসা বলেছেন, তিনি চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মুখে কোনো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হবেন না। এমন পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের পরিকল্পনা কী সেটাও বলবেন না।
ভারতের এবার বাছাইয়ের পালা
চীন ইতোমধ্যে তার পুরোনো বন্ধু মাহিন্দাকে উদ্ধারের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। নিজ নির্বাচনি এলাকায় হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর এবং এর পাশেই মাত্তালায় একটি বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য এই চীনের সঙ্গেই মাহিন্দা চুক্তি করেছিলেন।
আইএমএফের কাছে শ্রীলঙ্কার ঋণ চাওয়ার বিষয়ে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে দেশটিতে চীনা রাষ্ট্রদূত কিউই জেনহং আপত্তি জানান। তিনি বলেছিলেন, এ ঘটনা ঋণের জন্য কলম্বো এবং বেইজিংয়ের মধ্যে চলমান আলোচনাকে প্রভাবিত করবে। শ্রীলঙ্কার কাছে চীনের এখনও পাওনা রয়েছে ৬৫০ কোটি ডলার।
তবে মে মাসের শুরুতে রাষ্ট্রদূত কিউই ঝড়ের গতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রী আলি সাবরিকে বলেন, চীন আইএমএফের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কাজ করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। সম্ভবত বেইজিং দেখেছে, ভারত কীভাবে তার নিজস্ব ঋণ পরিশোধের সময় পিছিয়ে দিয়েছে এবং নিজেকে গ্যারান্টার হিসেবে প্রস্তাব করে আইএমএফের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কার ঋণ পাওয়ার চেষ্টাকে সমর্থন করেছে।
শ্রীলঙ্কায় ভারতের কূটনীতি শুধু দ্বীপের অভ্যন্তরীণ সমালোচকদেরই নয়, গোটা অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকেও অবাক করেছে। দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ভারতের অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব গত ছয় মাসে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এর কারণ শুধু এই নয় যে নয়াদিল্লি কলম্বোর খেলাপি ঋণ সংকট দূর করতে ২ কোটি ৪০ লাখ সহায়তা দিয়েছে এবং দেশটিতে কয়েক টন জ্বালানি ও ওষুধও পাঠানো হয়েছে, বরং এর সঙ্গে ত্রিনকোমালেতে একটি তেল ট্যাংক ফার্ম পরিচালনায় দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিও করা হয়েছে।
এমন অস্থির ও বিভাজিত পরিস্থিতিতে ভারত জানে শুধু রাজাপাকসেদের নয়, শ্রীলঙ্কার জনগণকে তাদের সমর্থন করা উচিত। যেমন বুদ্ধ বলেছেন, মাঝপথটি দীর্ঘ এবং কষ্টকর হলেও সেই পথেই হাঁটা উচিত, বিশেষ করে যখন এর শেষটা আলো ঝলমলে হয়।