বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তালেবানের নাকের ডগায় আফিমের রমরমা কারবার

  •    
  • ৮ মে, ২০২২ ১৯:৪০

গত শুক্রবার ঈদের ছুটির আগে এক বার্তায় তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা পপি চাষের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি পুনরাবৃত্তি করেন। তবে এখন যেসব জমিতে পপি চাষ হচ্ছে, সেসবের কী হবে তা স্পষ্ট করেননি তালেবানপ্রধান।

হেরোইনের মূল উপাদান পপি ফুল বা আফিম। এই ফুল চাষের জন্য ব্যাপক পরিচিত দক্ষিণ এশিয়ার দেশ আফগানিস্তান।

দীর্ঘ দুই দশক পর আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আবারও এসেছে তালেবান। বিশ্বজুড়ে নিন্দার মুখে তারা গত মাসে পপি চাষে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তবে কতটা কার্যকর হয়েছে এই নিষেধাজ্ঞা?

এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে ভাইস ওয়ার্ল্ড নিউজ। তাদের একটি দল চষে বেড়িয়েছে পপি চাষের মূল কেন্দ্র হেলমান্দ এবং কান্দাহার অঞ্চলে।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হেলমান্দ প্রদেশে পপি এবং আফিম সম্পর্কিত তথ্য নিতে তালেবানের স্পষ্ট নিষেধ আছে। তাই তালেবানের চোখ এড়িয়ে প্রকৃত ঘটনা উন্মোচনে নেমে পড়েন ভাইসের অনুসন্ধানী দল।

হেলমান্দের প্রত্যন্ত শহর মুসা কালা। সেখানকার ব্যস্ত একটি মার্কেটে প্লাস্টিক ব্যাগে প্রকাশ্যেই বেচা হচ্ছে আফিম, অনেকটা শাকসবজি বিক্রির মতো। অন্যপাশে চলছে ফসল কাটার কাজ।

কিছুদিন আগেও তালেবানের শক্ত ঘাঁটি ছিল এই মুসা কালা শহর। আফগানিস্তানের অন্যসব গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মতো এখানে আমেরিকাবিরোধী মনোভাব প্রবল। এই অঞ্চলে বাড়ির বাইরে নারীর দেখা মেলা ভার।

আফিম ব্যবসা এই অঞ্চলে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এমন না যে কোনো মাফিয়া চক্র এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণ বাসিন্দারাই এই ব্যবসায় জড়িত। এদের অনেকে সচ্ছল, অনেকে আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। যুবক, বৃদ্ধ এমনকি তালেবান… সবাই বেচছে আফিম।

মুসা কালার কাছে ঘান্দেই গ্রামের বাসিন্দা ইজবুল্লাহ। ২৮ বছরের ইজবুল্লাহ একটি পপিক্ষেতের মালিক। দিন শেষে শ্রমিকদের দেখতে এসেছেন তিনি।

ভাইসকে ইজবুল্লাহ বলেন, ‘এখানে এমন কোনো পরিবার নেই, যার অন্তত একজন সদস্য পপি ক্ষেতে কাজ করছেন না।

‘নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার কয়েক দিন পর তালেবানরা বাড়ি বাড়ি এসে আমাদের জানায়, আপাতত ফসল কাটুন। তবে পরবর্তীতে এসব বন্ধ করতে হবে।’

মসজিদ এবং বাজারেও ফলাও করে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি প্রচার করে তালেবান। তবে আফিমসহ অন্যসব মাদকের বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট নয়।

নুর আহমদ নামে এক পপিচাষি বলেন, ‘তারা (তালেবান) যদি পপি চাষ নিষিদ্ধ করে, তাহলে আমাদের কাছে অর্থ উপার্জন এবং পরিবারকে খাওয়ানোর অন্য কোনো উপায় থাকবে না।’

সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির বাধা উপেক্ষা করে কাজে নেমে পড়েন নুর আহমদ। তার দৈনিক মজুরদের মধ্যে আছে স্থানীয় মাদ্রাসার ছাত্ররাও; অল্প কিছু অর্থের জন্য মরিয়া তারা।

আফগানিস্তানের অর্থনীতি ভয়াবহ বিপর্যস্ত। চলছে দুর্ভিক্ষ। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম বলছে, ২ কোটি ২৮ লাখ (আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক) তীব্র খাদ্যসংকটে আছে।

স্থানীয়রা বলছে, পপি চাষে নিষেধাজ্ঞার প্রধান কারণ যুব সমাজ। তাদের বাঁচাতেই এই নিষেধাজ্ঞা। অন্য কারণটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটি হলো বিদেশিদের খুশি করা।

পার্শ্ববর্তী কাজকি জেলায় ৪৪ বছরের এক পপিচাষি ভাইস ওয়ার্ল্ড নিউজকে জানায়, ‘আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তালেবান। তারা জনগণের কথা ভাবেনি।’

এর আগেও পপি চাষে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল তালেবান, সেটা ২০০০ সালে। তবে তা কার্যকর ছিল কেবল এক মৌসুমে। নতুন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর নিয়ে কৃষকরা সন্দিহান।

৪৪ বছরের এক পপিচাষি বলেন, ‘এটি এক বছর স্থায়ী হতে পারে। তবে আমি নিশ্চিত এটি সমস্যা সৃষ্টি করবে। নিষেধাজ্ঞার ফলে কৃষক এবং তালেবানদের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে।’

গত আগস্টে তালেবান ক্ষমতা নেয়ার আগেও পপি চাষে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু চাষিরা পুলিশকে ঘুষ দিয়ে চালিয়ে যেতেন চাষাবাদ।

এখন প্রশ্ন হলো, এতসব সতর্কতা ও জনসংযোগের মধ্যেও নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিক তালেবানরা? কারণ পপি চাষ ছাড়া কৃষক ও ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবে খোদ তালেবানরাও।

আফগানিস্তানের জিডিপির ১১ শতাংশ আসে আফিম থেকে। অনেকেই মনে করছেন, পশ্চিমাদের বাহবা পেতে এই আয় হারানোর ঝুঁকি নিচ্ছে তালেবানরা।

নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় বিপাকে আছেন কৃষকরা। তারা কাজ হারানোর পথে। আফিম চাষে অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন। এই চাষ বন্ধ হলে জমির মালিকরা অন্য ফসল চাষে ঝুঁকবেন। অনেক কৃষক কাজ হারাবেন। তাদের বাড়ি বা জমি থাকবে না।

আজরাত মোহাম্মদ নামে এক আফিমচাষি বলেন, আমি আবার রোপণের পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু তালেবানের নিষেধাজ্ঞার পর আমার ভাই আমাকে এ কাজে বাধা দেয়। কারণ ওদের শাস্তি ভয়াবহ।

আফগানিস্তানে পপি চাষের সময় পরিবর্তন হয়। উত্তর হেলমান্দের কাজকিতে পপি চাষের উপযুক্ত সময় এখনই। কিন্তু নিষেধাজ্ঞায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।

মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা খুব গরিব। ছোট ছোট বাচ্চা আছে। আশা করি আবার পপি চাষ করতে পারব।’

ধারণা করা হচ্ছে, পপি চাষ বন্ধে জমির মালিক কিংবা বড় ব্যবসায়ীদের সরাসরি টার্গেট করতে পারে তালেবান। এতে পরিস্থিতি বড় সংঘাতে গড়াতে পারে।

কাজাকি জেলার তালেবান ডেপুটি গভর্নর মৌলভি নুরুল হক বলেন, ‘আমি একটি পপি ক্ষেতের মালিক। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার পর চাষ বন্ধ করে দিয়েছি।

‘সরকার পপির রাজস্ব প্রতিস্থাপনের জন্য বিকল্প ফসল এবং অন্যান্য সংকট সমাধানের ‘প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছে।’

আফগানিস্তানের দক্ষিণজুড়ে সূত্রগুলো বলছে, টম্যাটো, গম, চাল, তুলা, বাদাম, শসা, ভুট্টা এবং এমনকি জাফরান চাষ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। অনেকে আবার পোল্ট্রিসহ অন্যান্য ব্যবসার কথা ভাবছেন।

নুরুল হক বলেন, ‘এগুলো সংকট সমাধানের পথ হতে পারে। তবে বাস্তবায়ন নিয়ে কিছুটা সংশয় আছে।’

ভাইস ওয়ার্ল্ড নিউজ আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চল ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে কৃষকরা তাদের শাসকদের সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন।

তালেবানরা একটি সূক্ষ্ম পথে চলছে

কাজকি জেলার দেহ বাবা বাজারের রাস্তায় পশ্চিমা সাংবাদিক নিরাপদ নয়। তাই ভাইস নিউজ আফিম বিক্রেতাদের সঙ্গে গোপন এক জায়গায় দেখা করেন। সেখানে সবজির আড়ালে এবং মাটির দেয়ালের পেছনে আফিম লুকিয়ে রাখা আছে।

কাজাকির একজন প্রধান আফিম ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় ভাইসের। তিনি এই এলাকার আফিম ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। একটি অন্ধকার ঘরে তাকে বসে থাকতে দেখা গেছে আফিম বিক্রির অপেক্ষায়।

ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘তালেবান সরকার যদি আমাদের বিকল্প না দেয়, তাহলে হয়তো জনগণ বিদ্রোহ করবে, যুদ্ধ করবে। কিন্তু যদি যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে জানে তবে তারা আমাদের অনেক অর্থ দেবে।’

স্থানীয় তালেবান নেতারা পিক-আপ ট্রাকে চেপে লাউডস্পিকারে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছিল। তবে তারা কাজাকির আফিম ব্যবসায়ীদের বিরক্ত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বেশ কয়েকটি সূত্র বলছে, তালেবান স্থানীয়দের আফিম ব্যবসার অনুমতি দিলেও, কখনও কখনও তরুণ ডিলারদের গ্রেপ্তার করে তারা। এসব ডিলার হেলমান্দের দক্ষিণে মরুভূমি হয়ে পাকিস্তান সীমান্তের বরমচা বাজার থেকে আফিম নিয়ে আসেন।

গ্রেপ্তারের হুমকি সত্ত্বেও ডিলাররা চেকপোস্টসহ প্রধান সড়ক এড়িয়ে সীমান্তে আফিম আনতে থাকে। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, বিকল্প রুট ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা প্রায় অসম্ভব।

আফিম প্রক্রিয়াকরণ ল্যাবগুলোও বন্ধ করে দিচ্ছে তালেবান। নিষেধাজ্ঞার পর মুসা কালা জেলার ২০টি ল্যাবের মধ্যে ১৮টিই বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকরা।

এতসবের পরও অনেকে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। হেলমান্দ নদীর তীর ঘেঁষে একটি পরিত্যক্ত বাগানে ল্যাব চালু রেখেছেন ৩০ বছরের এক ব্যবসায়ী। ভাইসকে তিনি জানান, ল্যাবে আফিমকে পেস্ট করা হচ্ছে। এতে পরিবহনের সময় ঝুঁকি কমে আসে।

রাতে কথা হয় মুসা কালার কাছের আরেকটি গ্রামের এক তালেবান নিরাপত্তা কর্মকর্তার সঙ্গে; যিনি একটি পপি ক্ষেতের মালিক।

তিনি বলেন, ‘এখানে প্রতিটি পরিবারের একটি পা তালেবানের মধ্যে, অন্যটি আফিম ব্যবসায়। হেলমান্দের অনেক অংশে বিশেষ করে মুসা কালায় প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন সদস্য আফিম বা পোস্ত ব্যবসায় জড়িত। অন্যজন তালেবানের হয়ে লড়াই করছেন।’

আফিম ব্যবসায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত তালেবান

গত শুক্রবার ঈদের ছুটির আগে এক বার্তায় তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদা পপি চাষের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি পুনরাবৃত্তি করেন। তবে এখন যেসব জমিতে পপি চাষ হচ্ছে, এসবের কী হবে তা স্পষ্ট করেননি তালেবানপ্রধান।

ওই বার্তায় আফগান জনগণ বিশেষ করে কৃষকদের বিকল্প জীবিকা ও চাষাবাদের সন্ধান করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন আখুনজাদা।

অতীতেও এমন আহ্বান এসেছিল তালেবানের পক্ষ থেকে। তবে বিকল্প ফসল চাষে তেমন আগ্রহ দেখায়নি আফগানরা। এ ছাড়া নতুন ফসল চাষে অর্থায়ন করতে পর্যাপ্ত তহবিলও নেই তালেবানের হাতে। তারা বিদেশি টাকা আসার বিষয়ে বাজি ধরছে।

ইনডিপেনডেন্ট কনসালটেন্ট ডেভিড ম্যানসফিল্ড দুই দশক ধরে আফগানিস্তানের অর্থনীতি এবং গ্রামীণ জীবিকা নিয়ে কাজ করেছেন।

তিনি বলেন, ‘আফিমের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য অলৌকিক ফসলের অনুসন্ধান বেশ কঠিন। গত ২০ বছরের প্রমাণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আফিম থেকে সরানোর জন্য কৃষকদের উন্নত নিরাপত্তা, শাসন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কাকতালীয় অভিজ্ঞতার প্রয়োজন।

অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, তালেবান কেবল বিদেশি আর্থিক সাহায্য টানার জন্য নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করছে।

এ প্রসঙ্গে ম্যানসফিল্ড বলেন, ‘সমালোচকরা এই নিষেধাজ্ঞাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য চাপ সৃষ্টির প্রচেষ্টা হিসেবে দেখতে পারে। তবে তালেবানকে অর্থায়ন করা পশ্চিমাদের ভুল সিদ্ধান্ত হবে।

‘আফগানিস্তানে এর আগে অনেকবার এমনটা করা হয়েছে। তবে এটি কখনই ভালোভাবে শেষ হয় না। মাদক ব্যবসার ওপর নিষেধাজ্ঞার জন্য ‘তাড়াহুড়ো বা চাপ প্রয়োগ করা উচিত না। নতুন সরকার এমন একটি কৌশল বেছে নিয়েছে যা জনগণকে আরও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেবে।’

এ বিভাগের আরো খবর