পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের বাইরে গত ২৬ এপ্রিল আত্মঘাতী বোমা হামলায় হামলাকারীসহ পাঁচজন প্রাণ হারান। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। তারা বলছে, দুই সন্তানের জননী ও স্কুলশিক্ষক শারি বালুচ এ হামলা চালান। শারি আত্মঘাতী হামলা চালানো বিএলএর প্রথম নারী কর্মী। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সভিত্তিক সাইট ভাইসের প্রতিবেদন ভাষান্তর করেছেন সঞ্জয় দে।
দারুণ সুখী ও প্রাণবন্ত এক পরিবার। জন্মদিন উদযাপনের রঙিন বেলুনে সাজানো ঘর। হাসিখুশি স্বামী-স্ত্রীর হাতেও বেলুন। পেছন থেকে ভেসে আসছে উচ্ছ্বসিত শিশুর কণ্ঠ। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের দিকে তাকান গভীর আবেগে। হাতের বেলুন ফাটিয়ে চলতে থাকে উদযাপন।
কিছুক্ষণ পর উষ্ণ আলিঙ্গনে সন্তানসহ সেলফি তোলেন তারা।
এমন মধুর পারিবারিক বন্ধনে থাকা কেউ আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিজেকে উড়িয়ে দেবেন, ধারণা করাও কঠিন। তবে সেটাই ঘটেছে পাকিস্তানের করাচি শহরে।
জন্মদিন উদযাপনের ভিডিওতে থাকা নারী শারি বালুচ গত ২৬ এপ্রিল আত্মঘাতী হামলা চালান করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের বাইরে। এতে তিনিসহ মোট পাঁচজন প্রাণ হারান।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, শারি তার হাতের একটি ব্যাগের ভেতরে রাখা বোমার বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের বহনকারী একটি মিনিভ্যান উড়িয়ে দেয়াই ছিল তার লক্ষ্য।
বিস্ফোরণে চীনা ভাষা প্রশিক্ষক ডিং মু পেং ও চেন সাই এবং কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের পরিচালক হুয়াং গুই পিং, ভ্যানের চালক পাকিস্তানি নাগরিক খালিদ নওয়াজ নিহত হন।
করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মঘাতী হামলায় নিহতদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরাওই হামলার পর টুইটারে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শারির আনন্দে মেতে থাকার ভিডিওটি প্রকাশ করেন তার স্বামী।
এই হামলা বহু পাকিস্তানিকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সঙ্গে জড়িত চীনারাও যে হামলার লক্ষ্য হতে পারেন, তা অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত।
চীনা ভাষা ও সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র মুস্তাজাব হুসেন বলছিলেন, ‘আমি ভেঙে পড়েছি। তারা (নিহত ৩ চীনা নাগরিক) আমাদের দেশের অতিথি ছিলেন, আমাদের ভাষা প্রশিক্ষণ দিতেন। তারা ছিলেন আমাদের অভিভাবক। পাকিস্তান তাদের কাছে দ্বিতীয় বাড়ির মতো ছিল।’
আত্মঘাতী হামলার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের দূরত্বে ছিলেন মুস্তাজাব।
ভাষা প্রশিক্ষক চেন সাইয়ের ভক্ত ছিলেন মুস্তাজাব। এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘তিনি (চেন) একজন দুর্দান্ত শিক্ষক ছিলেন। আমাদের কাছে কোনো কিছু কঠিন ঠেকলেই তিনি সাহায্য করতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। ক্লাসের বাঁধাধরা সময়ের দিকে তার কোনো খেয়াল থাকত না।
‘এমনকি রাতেও তিনি হোয়াটসঅ্যাপে আমাদের জিজ্ঞাসার জবাব দিতেন। আর বাকিরাও ছিলেন তার মতোই দারুণ শিক্ষক। তারা আমাদের জন্য বন্ধুত্ব ও মর্যাদার পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন।’
মুস্তাজাব বলেন, ‘তিনজনের হৃদয়েই ছিল পাকিস্তানের প্রতি প্রবল ভালোবাসা। ইনস্টিটিউটের পরিচালক একবার আমাদের বলেছিলেন, তিনি যখনই পাকিস্তানের বিমানবন্দরে পৌঁছান, তখনই মনে হয় নিজের বাড়িতে ফিরেছেন।’
এ হামলার দায় স্বীকার করেছে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। বিচ্ছিন্নতাবাদী এই গোষ্ঠী বেলুচিস্তান প্রদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। বেলুচিস্তান প্রচুর খনিজসমৃদ্ধ একটি প্রদেশ, তবে ইরান ও আফগান সীমান্তবর্তী অঞ্চলটি পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা হিসেবেও পরিচিত।
বঞ্চনার শিকার বেলুচিস্তান প্রদেশের স্বাধীনতার জন্য দুই দশক ধরে সশস্ত্র লড়াই করছে বিএলএ। তাদেরকে এরই মধ্যে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
হামলার পর করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছেবেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের আওতায় পাকিস্তানে প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীন। তবে বিএলএ মনে করছে এসব প্রকল্প বেলুচিস্তানে সম্পদের শোষণ ও বঞ্চনা আরও বাড়িয়ে দেবে। এ জন্য প্রকল্পগুলো ঠেকানোর কৌশল হিসেবে তারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা নাগরিকদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করেছে। দিনে দিনে বাড়ছে হামলার মাত্রা।
বিএলএ ২০২০ সালে পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জে হামলার দায় স্বীকার করে, যাতে প্রাণ হারান সাতজন। এর আগের বছর বিএলএ বন্দুকধারীরা গোয়াদর শহরের একটি হোটেলে গুলি চালিয়ে আটজনকে হত্যা করে। সংগঠনটি ২০১৮ সালে চীনা কনস্যুলেটে আত্মঘাতী বোমা হামলার দায়ও স্বীকার করেছিল, যাতে নিহত হন চারজন।
ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে জোর দিলেও বিএলএ সম্প্রতি ইসলামি উগ্রপন্থিদের মতোই আত্মঘাতী হামলার দিকে ঝুঁকছে। সংগঠনটি হুঁশিয়ার করে বলেছে, ‘চীনা শোষণ’ থেকে মুক্তির দাবি পূরণ না হলে তাদের শত শত ‘উচ্চ প্রশিক্ষিত’ পুরুষ ও নারী সদস্য আরও হামলার জন্য প্রস্তুত।
করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট লক্ষ করে পরিচালিত হামলা বিএলএর সঙ্গে বেলুচিস্তানের শিক্ষিত পেশাজীবীদের জড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। দলটি বলেছে, শারি বালুচ ছিলেন ৩০ বছর বয়সী স্কুলশিক্ষক। প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর শারি পরে শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বিষয়েও আরেকটি ডিগ্রি অর্জন করেন। বিএলএর প্রথম নারী কর্মী হিসেবে তিনি ২৬ এপ্রিল আত্মঘাতী বোমা হামলাটি চালান।
এক বিবৃতিতে বিএলএ বলেছে, শারি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় দুই বছর আগে সংগঠনের আত্মঘাতী শাখা মাজিদ ব্রিগেডে যোগ দেন। ‘আত্মত্যাগের মিশনে’ যুক্ত হওয়ায় সম্মতি দেয়ার পর সিদ্ধান্তটি ভেবে দেখতে তাকে সময় দেয়া হয়েছিল। তবে তিনি প্রতিজ্ঞা থেকে পিছু হটেননি। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালানোর বিষয়ে ছয় মাস আগে তিনি ফের নিজের সম্মতি জানান।
শারির স্বামী হাবিতান বশির বালুচ একজন দন্ত চিকিৎসক ও শিক্ষক। হামলার পরদিন তিনি জন্মদিন অনুষ্ঠানে শারির উচ্ছ্বসিত ভিডিওটি টুইট করেন। হাবিতান লেখেন, ‘শারি জান, তোমার আত্মোৎসর্গ আমাকে নির্বাক করে দিয়েছে, তবে আমিও আজ গর্বিত।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘প্রিয় শারু, তোমার সঙ্গে কাটানো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টিকে আমি আজীবন লালন করব। তুমি সব সময় থাকবে আমার পাশে।’
অবশ্য পরে তদন্তকারীরা হাবিতানকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তিনি দাবি করেন, তার স্ত্রী ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ ছিলেন এবং নিয়মিত ওষুধ খেতেন।
দুই সন্তানের মা শারির পরিচিতদের কাছে ঘটনাটি এখনও অবিশ্বাস্য।
শারির চাচা বিশিষ্ট বেলুচ লেখক এবং অধিকার কর্মী গনি পারভেজ বলেন, ‘আমরা সবাই হতবাক, ওর বাবাও হতবাক। এমন কিছু ঘটবে আমরা কখনও কল্পনা করিনি। শারি ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল, কোমল হৃদয় ও বুদ্ধিমান মেয়ে। সব সময় সবার প্রতি ছিল যত্নশীল ও আন্তরিক। কখনও সে অন্যের বা নিজের ক্ষতি করার কথা ভাবেনি।’
এ ঘটনায় পরিবার প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছেন বলে স্বীকার করেন পারভেজ। তবে একই সঙ্গে তিনি মনে করেন বেলুচিস্তানে ভয়াবহ বাস্তবতাই শারির মতো শিক্ষিত নারীকে উগ্রপন্থার দিকে প্ররোচিত করেছে। তিনি বলেন, ‘বেলুচিস্তানের অবস্থা খুবই খারাপ। আর তাই নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত সরকার এ বিষয়ে কোনো গা করছে না।
‘আমরা গুম, হত্যা, লাশের ওপর লাশ এবং নির্যাতন দেখেছি। এগুলোর পরিবর্তন ঘটানো জরুরি, বেলুচিস্তানের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা দরকার।’
ভূমির পরিমাণ বিবেচনায় বেলুচিস্তান পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ। তবে এটিই দেশটির সবচেয়ে কম জনবহুল, স্বল্পোন্নত ও স্বল্প শিক্ষিত এলাকা। পুরো পাকিস্তানের বিদ্যুতের উৎপাদন এই প্রদেশের কয়লা ও গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। অথচ বেলুচিস্তানের এক কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য বিদ্যুৎ ও সুপেয় পানির জোগান অনেকটাই সীমিত। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ, এমনকি স্বাস্থ্যসেবাও পাকিস্তানের বাকি অংশের চেয়ে অনেক কম।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, অর্থনৈতিক বঞ্চনা, রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং সহিংসতার ফলে তৈরি হওয়া ক্ষোভ বেলুচিস্তানের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রতি তাদের সহানুভূতি দিনে দিনে জোরালো হচ্ছে। শারির আত্মঘাতী হামলা এই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।
বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনের নামে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী হাজার হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মী বা জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত সন্দেহে অপহরণ ও গুমের ঘটনা অজস্র। বিনা বিচারে বা যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই অনেক অধিকার কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের আটক রাখা হয়েছে। কেউ কেউ মাসের পর মাস বা বছর ধরে নির্যাতন সহ্য করছেন।
কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটে হামলার পর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা লাহোর শহর ও করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই বেলুচ ছাত্রকে তুলে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অপহরণের নিন্দা করেছেন অধিকার কর্মীরা।
পারভেজ সতর্ক করে বলছেন, ‘এ অবস্থা পাকিস্তানের জন্য আরও সমস্যা তৈরি করছে। বৈষম্য এবং হত্যাকাণ্ড আমাদের অঞ্চলে পাল্টা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে বাধ্য। এর অবসান হওয়া দরকার। এটি কেবল ঘৃণাই সৃষ্টি করছে। মানুষ, বিশেষ করে তরুণেরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠছে।’
পাকিস্তানের সাবেক সিনেট চেয়ারম্যান রাজা রব্বানীও একই সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘চরম জাতীয়তাবাদী চেতনা এত প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে শিক্ষিত নারীরাও জীবন দিতে তৈরি। এর অর্থ হলো নিপীড়ন, দমন, বিচ্ছিন্নতা এবং বঞ্চনাবোধের বীজ অনেক গভীরে প্রোথিত। এ অবস্থা রাষ্ট্র ও এর কৌশলগত স্বার্থের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিক্রিয়াকে প্ররোচিত করছে।’
পাকিস্তানের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলেছে, সবশেষ হামলাটির জন্য তারা বিএলএর দুই কমান্ডারের বিরুদ্ধে হত্যা ও সন্ত্রাসের অভিযোগ আনবে। পুলিশ কর্তারা বলছেন, তাদের বিশ্বাস পাকিস্তান ও চীনের সুসম্পর্ক নষ্ট করার উদ্দেশ্যেই এ হামলা, আর এতে মদদ দিয়েছে একটি ‘বিদেশি শত্রু সংস্থা’।
পাকিস্তান এর আগে অনেকবার বিএলএকে গোপনে অর্থায়ন ও সমর্থনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে দায়ী করেছে। তবে এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে ভারত।
অন্যদিকে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে’ পাকিস্তানের পদক্ষেপকে সমর্থনের আশ্বাস দিয়েছে বেইজিং। হামলায় জড়িতদের চরম মূল্য দিতে হবে বলেও হুঁশিয়ার করেছে তারা। ঘটনার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে, ক্যাম্পাসে ঢোকার সময় তল্লাশি করা হচ্ছে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে।