রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর সম্মানে জাহাজটির নাম রাখা হয়েছিল মস্কভা। সোভিয়েত আমলে নির্মিত এই যুদ্ধজাহাজ জর্জিয়া, সিরিয়ায় সংঘাতে অংশ নিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে এর অস্ত্রাগারে আগুন লাগার পর সমুদ্রের বুকেই তার সলিল সমাধি ঘটেছে। মস্কভা শুধু একটি রণতরী নয়, এটি ছিল রুশ নৌবাহিনীর কৃষ্ণসাগর ফ্লিটের অহংকার।
শুরুতে যেই জাহাজকে শ্লাভা অর্থাৎ গৌরব বলে ডাকা হতো, তার জন্য এটি অপমানজনক সমাপ্তি।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, শান্তিকালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও যৌথভাবে বিভিন্ন গবেষণাকাজে অংশ নিয়েছিল মস্কভা।
মস্কভার শেষ পরিণতি
অভ্যন্তরীণ অস্ত্রাগারে বিস্ফোরণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত রণতরীটি তীরে নোঙর করার সময় সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়।
তবে ইউক্রেন দাবি করছে কৃষ্ণসাগরে মোতায়েন রাশিয়ার ফ্ল্যাগশিপে বুধবার ইউক্রেনীয় সেনাদের দুটি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। এ সময় রণতরীতে আগুন ধরে যায়।
এর প্রকৃত সামরিক মূল্যের থেকেও এর সামগ্রিক মর্যাদা বেশি। স্বাভাবিকভাবেই, বর্তমান সামরিক অভিযানে এর খুব একটা ভূমিকা নেই। এটি ডুবে যাওয়াতেও অভিযানের কোনো প্রভাব পড়বে না।
কিয়েভের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি মস্কো। একই সঙ্গে ইউক্রেনীয় বাহিনীও তাদের দাবির সপক্ষে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে পারেনি।
রণতরীতে থাকা ৫১০ ক্রু ও মেরিন সেনাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে মস্কো। তবে বিস্তারিত কিছু জানায়নি রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
ডূবে যাওয়ার ৬ দিন আগে মাক্সারের ছবিতে মস্কভা
মস্কভা ডুবে যাওয়ার তাৎপর্য
১২ হাজার ৫০০ টনের আটলান্ট-ক্লাস মিসাইল ক্রুজার এই মস্কভা জাহাজটি রুশ নৌবাহিনীতে সার্ভিস দিয়ে আসছে ১৯৭৯ সাল থেকে। এর মধ্যে রয়েছে ১৬টি অ্যান্টি-শিপ ক্ষেপণাস্ত্র, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, টর্পেডো ও গান। কৃষ্ণসাগরে মোতায়েন আটলান্ট-ক্লাসের এটিই একমাত্র জাহাজ। এ ছাড়া বাকি দুটি মিসাইল ফ্রিগেট ‘মার্শাল উসতিনভ’ ও ‘ভারইয়াগ’ রাশিয়ার নর্দান ও প্যাসিফিক ফ্লিটে মোতায়েন রয়েছে।
দ্য ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার (আইওডব্লিউ) বলছে, এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে ইউক্রেনের আঘাতেই মস্কভা ডুবেছে কি না। তবে মস্কভা হারানো সেটা যে কারণেই হোক না কেন, ইউক্রেনের প্রপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য এটি বড় বিজয়।
মস্কভা ডুবে যাওয়া রুশ নৌবাহিনীর আত্মবিশ্বাসেও চিড় ধরাবে।
কিন্তু সামরিক বিবেচনায় মস্কভা ডুবে যাওয়াতে রাশিয়ার যুদ্ধ পরিকল্পনায় খুব একটা ব্যাঘাত ঘটার কথা নয়।
এ জাহাজটি ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকেই কৃষ্ণসাগরে মোতায়েন ছিল।
আইওডব্লিউ বলছে, মস্কভা সম্ভবত ইউক্রেনের সামরিক সরঞ্জামকেন্দ্রগুলোতে ও বিমানঘাঁটিগুলোতে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে ব্যবহৃত হতো।
এ ধরনের হামলা খুব কাজে দিলেও বিমান হামলা কিংবা ভূমি থেকে নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় এর তাৎপর্য খুবই নগণ্য।
রাশিয়ার সামরিক বিশ্লেষক আলেক্সান্ডার খ্রামাচিখিন মস্কভা ডুবে যাওয়াকে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘জাহাজটি খুবই পুরোনো। প্রায় ৫ বছর আগে থেকেই একে অবসরে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল।
‘এর প্রকৃত সামরিক মূল্যের থেকেও এর সামগ্রিক মর্যাদা বেশি। স্বাভাবিকভাবেই, বর্তমান সামরিক অভিযানে এর খুব একটা ভূমিকা নেই। এটি ডুবে যাওয়াতেও অভিযানের কোনো প্রভাব পড়বে না।’
মস্কভার ইতিহাস
মস্কভা একটি আটলান্ট-ক্লাস ক্রুজার যুদ্ধজাহাজ। ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরীর বিরুদ্ধে কার্যকর অস্ত্র হিসেবে এটিকে নকশা করা হয়। এ ছাড়াও দূরবর্তী মোতায়েন সোভিয়েত জাহাজগুলোকে আকাশ প্রতিরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রেও কার্যকর ছিল।
বিমানবাহী রণতরীর বিরুদ্ধে কার্যকারিতার জন্য এটিকে ‘ক্যারিয়ার কিলার’ হিসেবে ডাকা হতো।
আর মস্কভা, যার নাম ছিল ‘স্লাভা’, তৈরি করাই হয়েছিল ইউক্রেনের মাইকোলাইভের শিপইয়ার্ডে। সময়ের পরিক্রমায় ইউক্রেনই এখন এটিকে ডুবিয়ে দেয়ার দাবি করছে।
জাহাজটি খুবই পুরোনো। প্রায় ৫ বছর আগে থেকেই একে অবসরে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল।
১৯৭৯ সালে এটি তৈরি হলেও এর তিন বছর পর এটি সোভিয়েত নৌবাহিনীতে কমিশন পায়। কৃষ্ণসাগর ফ্লিটের এটিই ছিল ফ্ল্যাগশিপ। ১৮৬ মিটার লম্বা জাহাজটিতে ৬২ জন অফিসারসহ ৪৭৬ জন ক্রুয়ের থাকার ব্যবস্থা ছিল।