ক্ষমতায় এসেই কাশ্মীর ইস্যুতে মনোযোগ দিলেন পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। জানিয়েছেন, ভারতের সঙ্গে কাশ্মীর বিরোধের একটি ‘শান্তিপূর্ণ’ নিষ্পত্তি ‘অপরিহার্য’।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শাহবাজকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। জবাবে মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়ে শাহবাজ বলেন, "দিল্লির সঙ্গে ইসলামাবাদ 'শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক' সম্পর্ক চায়। কূটনৈতিক সম্পর্কে আমরা জোর দেব।"
এক টুইটে পাকিস্তানের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘অভিনন্দনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ। ভারতের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক চায় পাকিস্তান। জম্মু ও কাশ্মীরসহ বিরোধপূর্ণ ইস্যুগুলোতে শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি অপরিহার্য।
‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তানের আত্মত্যাগ সর্বজনবিদিত। আসুন শান্তি সুরক্ষিত করি এবং আমাদের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করি।’
ইমরান খানকে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হারিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সোমবার পাকিস্তানের মসনদে বসেন মুসলিম লীগের এই নেতা।
উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ১৯৪৭ সাল থেকে কাশ্মীরের হিমালয় অঞ্চল নিয়ে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দুটির বিবাদ লেগে আছে।
মনোরম উপত্যকাটি পাকিস্তান এবং ভারত ভাগাভাগি করে নিলেও দুই দেশই পুরো কাশ্মীর দাবি করে আসছে। এই কাশ্মীরের একটি অংশ আবার রয়েছে চীনের নিয়ন্ত্রণে।
কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান গত ৭৫ বছরে তিনবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়েছে। ব্রিটিশদের শাসন থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পরের বছর ১৯৪৮ সালে প্রথম দফা যুদ্ধে জড়ায় দিল্লি-ইসলামাবাদ। ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালেও হয়েছিল লড়াই।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলো প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চাইছে। তাই তারা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হিসাবে, ১৯৮৯ সালে নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে এই অঞ্চলে সংঘর্ষে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
উত্তেজনা আরও তীব্র হয় ২০১৯ সালের আগস্টে। মোদি সরকার ভারতশাসিত কাশ্মীরকে তার বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা কেড়ে নেয় সে মাসে।
শাহবাজের বিবৃতির প্রতিক্রিয়া
ভারতশাসিত কাশ্মীরের ভারতপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, তারা সব সময় কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে দিল্লি-ইসলামাবাদের মধ্যে আলোচনার পক্ষে আছেন।
জম্মু-কাশ্মীরের একটি রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের মুখপাত্র ইমরান নবী দার আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার পক্ষে। সব সময়ই তা চেয়ে এসেছি।
‘দুই দেশের বৈরিতার কারণে কাশ্মীরিরা ভুগছে। আমরা চাই দুই দেশ আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান করুক।’
কাশ্মীরের শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিদ্দিক ওয়াহিদ অবশ্য আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। এই বিশ্লেষক মনে করেন, শাহবাজ শরিফের বক্তব্য ইসলামাবাদের নিয়মিত ঘটনার অংশ শুধু।
সিদ্দিক ওয়াহিদ বলেন, ‘এই মুহূর্তে কাশ্মীরের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য পাকিস্তানে নতুন প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিকে ইসলামাবাদের একটি নিয়মিত আয়োজন হিসেবে বিবেচনা করি। কারণ এটা কল্পনা করা কঠিন যে, ইসলামাবাদের কেয়ারটেকার সরকারের সঙ্গে কাশ্মীর ইস্যুতে আলোচনায় বসবে দিল্লি।’
তবে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং ফোর্স ম্যাগাজিনের সম্পাদক প্রভিন সাহনি বলছেন, পাকিস্তানের নেতার বক্তব্যে ভারতের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত।
তিনি বলেন, ‘ভারতের উচিত আলোচনা শুরু করা। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া উচিত। আমি দেখছি, এতে দুই পক্ষই আগ্রহী। তাই দেরি না করাই ভালো।’
দিল্লিঘেঁষা শরিফ পরিবার
শাহবাজের বড় ভাই নওয়াজ শরিফ ছিলেন পাকিস্তানের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তার শাসনামলে দিল্লি-ইসলামাবাদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করেছিলেন।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নওয়াজ শরিফ। পিছিয়ে থাকেননি মোদিও। পাকিস্তানে শরিফ পরিবারের এক বিয়েতে মোদির উপস্থিতি চমকে দিয়েছিলেন বিশ্বকে।
শরিফ পরিবার যেখানে দিল্লির সঙ্গে সমঝোতামূলক এবং আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে জোর দিয়েছিলেন, সেখানে বিপরীত অবস্থানে ছিলেন ইমরান খান।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়ার জবাবে দিল্লির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ফাটল তীব্র হয়। স্থগিত করা হয়েছিল সরাসরি বাণিজ্য সুবিধা।
নরেন্দ্র মোদির হিন্দু-জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের ঘোর সমালোচক ছিলেন ইমরান। ভারতে উগ্রবাদীদের হাতে সে দেশের মুসলিম নাগিরকদের হত্যার বিচার চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মহলে।
ইসলামাবাদের সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের ইমতিয়াজ গুল বলেন, ‘পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে 'সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক' মেনে চলেছে শরিফ ভাইরা। তাই শান্তি আলোচনার উপযুক্ত সময় এখনই।
শাহবাজ শরিফ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০১৩ সালে ভারত সফরে এসেছিলেন। কেবল তাই নয়, সীমান্তের ভারতীয় অংশে নিজেদের পৈতৃক গ্রাম পরিদর্শন করেন শাহবাজ। সে সময় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর চলা উত্তেজনা কমে আসতে পারে নতুন প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে।
দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অজয় দর্শন বেহেরা বলেন, ‘তিনি এমন কেউ নন যে ভারতকে বিরোধিতা করার চরম পর্যায়ে যাবে।’