ভেঙ্কেট সানমুগাম, জাতিগতভাবে একজন তামিল। বসবাস করেন শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে। সরকারি একটি অফিসে জুনিয়র ডিভিশন ক্লার্কের কাজ করেন তিনি। শ্রীলঙ্কার চলমান অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে তার পরিবার ভাত, সবজি, চিনি ও দুধ ছাড়া চায়ের ওপরই বেঁচে আছে। মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করেও বাজারে খাদ্যসামগ্রী পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো বন্ধ, দেশটির নাগরিকরা নিজের সঞ্চিত টাকাই তুলতে পারছেন না। জ্বালানির ঘাটতি রয়েছে। এমন সমস্যা শুধু ছোট চাকরি করা মানুষদেরই হচ্ছে না, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জ্বালানি তেল পাচ্ছেন না।
যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব জ্বালানি পাম্পের সামনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ভেঙ্কেট ভাবছেন, এভাবে আর কত দিন বেঁচে থাকবেন। তার কিছু আত্মীয় ভারতে থাকেন। শুধু পরিবার নিয়ে খেয়ে-পরে বাঁচতে তিনি ভারতে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন।
শুধু কলম্বোর ক্ষেত্রেই এই অবস্থা নয়, শ্রীলঙ্কার প্রায় প্রতিটি শহরেরই দুর্বিষহ অবস্থা। নিকট ভবিষ্যতে এই অচলাবস্থা কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণও দেখছেন না দেশটির নাগরিকেরা।
লঙ্কা যখন পুড়ছে আগুনে, তখনই আসলে প্রশ্ন জাগছে এ আগুন কীভাবে নেভানো যাবে।
ডিএনএ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনীতির এই বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে এখনও বেশ কিছু রাস্তা খোলা আছে দ্বীপ দেশটির।
আমদানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ
মূল্যবান বৈদেশিক রিজার্ভ সংরক্ষণের জন্য শ্রীলঙ্কা সরকারকে আমদানি ঠেকাতে পর্যাপ্ত নীতি প্রণয়ন করতে হবে। অর্থনীতি স্থিতিশীল অবস্থায় না আসা পর্যন্ত এটি একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে। বর্তমানে দেশটির বৈদেশিক রিজার্ভ আছে ২ বিলিয়ন ডলার। যদিও ঋণ ও সার্বভৌম বন্ডের কারণে রিজার্ভ প্রকৃত অর্থে ১ বিলিয়ন ডলারেরও কম।
সরকার পুনর্গঠন
শ্রীলঙ্কা সরকারকে চালাচ্ছে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার দুই ভাই। পরিবারচালিত সরকার, দেশটির আর্থিক পতনের যে লক্ষণ দেখা দিয়েছিল তারা তা উপেক্ষা করেছে। তাই পরিবারতান্ত্রিক সরকার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে শ্রীলঙ্কাকে। যেখানে বিরোধী নেতাসহ অন্যদেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার সুযোগ থাকতে হবে। এটি একটি জাতীয় সংকট। তাই জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও গ্রেপ্তার করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। বরং সমন্বিতভাবে মোকাবিলার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এমনটা করতে ব্যর্থ হলে ধরপাকড় ও গ্রেপ্তার করলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ আরও তীব্র হবে এবং যা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থানেরও কারণ হতে পারে।
রাসায়নিক সার নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বিবেচনা করা
দেশের কৃষি উৎপাদন অর্ধেকে নেমে যাওয়ার একটি বড় কারণ হলো রাসায়নিক সারের ওপর নিষেধাজ্ঞা। এই ধরনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়োর সুযোগ নেই। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা উচিত। তবে আপাতত সারের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা জরুরি।
ব্যয় হ্রাস ও আয় বৃদ্ধি
কলম্বো সরকারকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে। যে নীতি ব্যয় কমিয়ে আনার পাশাপাশি আয়ের বৃদ্ধির দিকে জোর দেবে। ব্যয়ের অন্যতম প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে একটি হলো শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনী। যেখানে সাড়ে চার লাখের বেশি লোক কাজ করে। গৃহযুদ্ধের পরে শ্রীলঙ্কার সেই অর্থে ব্যাহিক হুমকি কম। কিন্তু বর্তমান সরকার সামরিক ব্যয় কমানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
অন্যান্য দেশ থেকে সাহায্য নেয়া
চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় অন্যান্য দেশ থেকে সাহায্য চাইতে পারে শ্রীলঙ্কা। চীন এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ভারতও প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য একই পরিমাণ ক্রেডিট লাইন দিয়েছে শ্রীলঙ্কা।
ট্যাক্স ফাঁকি ও দুর্নীতি কমিয়ে আনা
শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক নেতারা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। তারাই বিভিন্ন ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও ট্যাক্স পরিশোধের ক্ষেত্রে তাদের অনীহা রয়েছে। ট্যাক্সসংক্রান্ত দুর্নীতিও দেশটিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সরকার ব্যাপক অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা কমাতে যেকোনো মূল্যে দেশটিকে ট্যাক্স ফাঁকি ও দুর্নীতি কমাতে হবে।
এ ছাড়াও দেশটিকে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দিকে জোর দিতে হবে। বৈশ্বিকভাবে কোভিড পরিস্থিতি কেটে যাওয়ায় শ্রীলঙ্কার উচিত হবে পর্যটনশিল্পকে চাঙা করতে পদক্ষেপ নেয়া। সর্বোপরি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।