পাকিস্তানে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তী নির্বাচনের আদেশ খারিজ করে দিয়েছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। পার্লামেন্ট চালুর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটির নির্দেশও দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
ইমরানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব দেশটির ডেপুটি স্পিকার অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দিলেও এবার সেই প্রস্তাবের ভোট নিতে হচ্ছে আগামী শনিবার, যা হওয়ার কথা ছিল সাত দিন আগে।
শনিবার ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে অধিবেশন ডাকতে বলা হয়েছে প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভিকে। এমনকি কখন ভোট হবে, তার সময় ঠিক করে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় আয়োজন করতে হবে ভোটের। স্পিকার আসাদ কাসিরকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্ডিয়ালসহ পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ এই আদেশ দেয়।
আদালত জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব সফল হলে, বিধানসভা নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবে।
এই আদেশে পাকিস্তানের ভঙুর রাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায় দেখা গেল। ভেঙে যাওয়া পার্লামেন্টের পুনরুত্থানের বিরল রেকর্ডের মালিক হতে যাচ্ছে দেশটি।
ব্রিটিশ রাজ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার ৭৫ বছরেও কোনো সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করতে না পারার যে অস্বস্তিকর রেকর্ড আছে দেশটিতে, সেটির এবার অবসান হয় কি না, এমন আলোচনা ছিল ইমরানকে নিয়ে।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত সাফল্য পেয়ে ইমরান যখন ক্ষমতায় নিজের অবস্থান পোক্ত করে ফেলেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল, সেই সময় বিরোধী পক্ষ থেকে এল এমন এক চাল, যা ইমরান খানকে হতবিহ্বল করে দিয়েছে।
জোট সঙ্গী কয়েকজনের পক্ষ ত্যাগ, সবচেয়ে বড় কথা নিজ দলে বিদ্রোহে অনাস্থা ভোটে তার পরাজয় যখন চোখ রাঙাচ্ছে, তখন আবার পার্লামেন্টে আসে এক নজিরবিহীন আদেশ।
ভোটের দিন ৩ এপ্রিল ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি এই প্রস্তাবকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে খারিজ করে দেন এই বলে যে, এই প্রস্তাব বিদেশিদের চক্রান্তে আনা হয়েছে। তাই এর ওপর ভোটাভুটি হতে পারে না।
তাহলে ইমরান কি এই যাত্রায় টিকে গেলেন-এই প্রশ্নের মধ্যে বিরোধীদের হট্টগোলের সময় আবার আসে আরেক ঘোষণা, যেটি আরও চমক তৈরি করে।
প্রেসিডেন্ট আলভিকে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার আহ্বান জানান ইমরান। সেই অনুযায়ী কাজ করেন রাষ্ট্র প্রধান। সেই সঙ্গে জানিয়ে দেন, ভোট হবে ৯০ দিনের মধ্যে।
এই ঘোষণার পরে আসে আরেক চমক। প্রধান বিচারপতি জানান, প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তই শেষ কথা নয়। এ বিষয়ে তার কিছু বলার আছে।
এরই মধ্যে আবার পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দেয়, ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে তারা প্রস্তুত নয়।
দেশটির রাজনীতিতে নতুন করে কালোমেঘের ঘনঘটার আশঙ্কার মধ্যে বৃহস্পতিবার শুনানি হয় সুপ্রিম কোর্টে।
শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্তে আসে, প্রেসিডেন্টকে বিধানসভা ভাঙার পরামর্শ দেয়ার এখতিয়ার নেই প্রধানমন্ত্রীর। তাই সেদিন থেকে পার্লামেন্ট যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা বাতিল করা হলো।
শুনানিতে যা হয়েছে
ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করে দেয়ার আদেশের যে কপি আদালতে জমা দেয়া হয় তাতে স্পিকার আসাদ কায়সারের স্বাক্ষর রয়েছে বলে জানান বিচারপতি জামাল খান মান্দোখেল। অথচ বিষয়টি খারিজ করেছিলেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি।
ডেপুটি স্পিকারের আদেশের বৈধতা নিয়ে চলা স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) শুনানিতে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তাদের আইনজীবী নাইম বুখারি। তখন বিষয়টি নজরে আনেন এই বিচারপতি।
জবাবে বুখারি বলেন, সম্ভবত বিচারপতিকে যে নথি দেয়া হয়েছে, তা ‘আসল’ নয়।
প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্ডিয়ালের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারকের বেঞ্চে বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল প্রায় সাড়ে ৯টায় পঞ্চম দিনের শুনানি শুরু হয়। এই বেঞ্চে আরও ছিলেন বিচারপতি ইজাজুল আহসান, মোহাম্মদ আলী মাজহার, মুনিব আখতার ও জামাল খান মান্দোখেল।
যুক্তি উপস্থাপনে বুখারি বলেন, ‘অতীতে সংসদীয় কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত ছিল সর্বোচ্চ আদালত। জানতে চান, স্পিকার যদি ফাওয়াদ চৌধুরীর পয়েন্ট অব অর্ডার খারিজ করে দিতেন, তবে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত নোটিশ গ্রহণ করে শুনানি করতেন কি না।
‘অতীতে যখন জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেয়া হয়েছিল, তখন তা অসাংবিধানিক ঘোষণা করার পরও নির্বাচনি প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়নি। পয়েন্ট অব অর্ডার আমলে নিয়ে স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করে দিতে পারেন। অতীতে কখনও না হলেও স্পিকারের তা করার ক্ষমতা আছে।’
বিচারপতি মান্দোখেল এক পর্যায়ে জানতে চান, কোন আইনে স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করে দিতে পারেন। আমরা পয়েন্ট অব অর্ডারের সংজ্ঞা বুঝতে চাই।’
বিচারপতি মান্দোখেল বলেন, ‘অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট সাংবিধানিক অধিকার। রুলিং দিয়ে ভোটের অধিকার অবৈধ ঘোষণা করা যায় কি না।’
প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন রাখেন, ‘বিরোধীদের কি পয়েন্ট অব অর্ডারের জবাব দেয়ার সুযোগ দেয়া উচিত ছিল না?’
জবাবে আইনজীবী বুখারি বলেন, ‘এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে না।’
বুখারি জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সংসদীয় কমিটির বৈঠকের কার্যবিবরণীও তুলে ধরেন। যেখানে পার্লামেন্ট সদস্যদের ‘হুমকির চিঠির’ বিষয়বস্তু জানানো হয়েছিল। কমিটিকে দেয়া ব্রিফিংয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পরিষদের কমিটিকে জানানো হয়েছে-যদি অনাস্থা প্রস্তাব ব্যর্থ হয়, তাহলে পরিণতি ভোগ করতে হবে।’
এ সময় বিচারপতি মান্দোখেল বলেন, ‘আদেশ দিয়েছিলেন ডেপুটি স্পিকার কিন্তু আদেশে স্বাক্ষর স্পিকারের।’
তিনি জানতে চান, ‘ডেপুটি স্পিকারের স্বাক্ষর কোথায়? সংসদীয় কমিটির কার্যবিবরণীতে প্রমাণ হয় না যে ডেপুটি স্পিকার ওই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।’
জবাবে বুখারি বলেন, ‘বিচারপতির কাছে থাকা আদেশের নথি সম্ভবত আসল নয়। এর পর আদালত বিরতিতে যায়। জানানো হয়, স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রায় দেবে আদালত।’
প্রেক্ষাপট
গত ৩ এপ্রিল ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব ‘অসাংবিধানিক’ বলে খারিজ করে দেন পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরি। এরপর ইমরান খানের পরামর্শ মেনে পার্লামেন্ট ভেঙে দেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এদিন জানান, ডেপুটি স্পিকারের সিদ্ধান্ত সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের স্পষ্ট লঙ্ঘন। পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার বিষয়টি দেশের শীর্ষ আদালতের আদেশের অধীন। এ বিষয়ে আদালতই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে। আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) এক নোটিশের ওপর শুনানি শুরু হয় রোববারই।
ইমরান খানের বিরুদ্ধে দেশ শাসনে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এনে গত ৮ মার্চ অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেয় বিরোধী দলগুলো। এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা ও ভোটাভুটির জন্য অধিবেশন ডাকতে স্পিকার আসাদ কায়সারের প্রতি লিখিত আবেদন জানান তারা।
- আরও পড়ুন: ইমরান খানের চেয়ার টলছে
পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, লিখিত আবেদন জমার ১৪ দিনের মধ্যে স্পিকারকে আলোচনার জন্য অধিবেশন ডাকতে হবে। সে অনুযায়ী ২২ মার্চের মধ্যে অধিবেশন আয়োজন করার কথা ছিল। তবে ২২ মার্চ থেকে জাতীয় পরিষদে ওআইসির দুই দিনব্যাপী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন শুরু হওয়ায় তা আর হয়নি। এর পরই অধিবেশনের তারিখ পেছায়।
বিরোধী পক্ষ গত ৩ এপ্রিল জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের পর ষড়যন্ত্রের কারণে এই প্রস্তাব তোলা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন কাশিম সুরি। পরে অধিবেশন মুলতবি করেন তিনি। বিরোধী দলগুলোর তোপের মুখে পড়তে হয় তাকে। স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ জানান বিরোধীরা। হট্টগোল তৈরি হয়।
অনাস্থা প্রস্তাবে টিকে থাকতে হলে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ইমরান খানকে অন্তত ১৭২ সদস্যের সমর্থন পেতে হতো। এরই মধ্যে তিন জোটসঙ্গী মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম-পি), পাকিস্তান মুসলিম লিগ-কায়েদ (পিএমএল-কিউ) এবং বালুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি) বিরোধী শিবিরে যোগ দেয়ার ইঙ্গিত দেয়ায় ব্যাপারটি অন্যদিকে মোড় নেয়।
এর আগে তিন বছরের মাথায় গত মার্চে অনাস্থা ভোট হয় ইমরানের বিরুদ্ধে। সেবার সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় অনায়াসেই উতরে গিয়েছিলেন তিনি।
- আরও পড়ুন: পাকিস্তানের ‘মুকুটে’ নতুন পালক ইমরান খান
দুর্নীতির দায়ে নওয়াজ শরিফ অভিশংসিত হওয়ার পর ২০১৮ সালে চার দলের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন তারকা ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরান খান। ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত তার নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সরকারের মেয়াদ ছিল।
পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার আদেশের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এখন প্রধানমন্ত্রী খুঁজছে পাকিস্তান। এ প্রেক্ষাপটে বিদায় নিতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একজনের নামও জমা দিয়েছেন।
- আরও পড়ুন: ইমরানের ধারণা, মস্কো সফরই কাল হচ্ছে তার
গত ৪ এপ্রিল সাবেক প্রধান বিচারপতি গুলজার আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করতে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি পাঠান ইমরান। এদিন সকালেই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফকে চিঠি পাঠান রাষ্ট্রপতি আরিফ আলভি। এতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর জন্য নাম জমা দিতে বলেন তিনি।