পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাবের পেছনে বিদেশি ষড়যন্ত্র কাজ করছে বলে দাবি করছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। জানিয়েছেন, পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে বিরোধীরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তার ধারণা, ফেব্রুয়ারির শেষে রাশিয়া সফরই কাল হচ্ছে তার।
পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান তার মেয়াদ পূরণ করতে পারেন কি না, এমন আলোচনা যখন বড় হচ্ছে, সে সময় সরকার থেকে তার সরে যাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত। পার্লামেন্টে তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে অনাস্থা প্রস্তাব। আর অভাবনীয় কিছু না হলে তার পরাজয় নিশ্চিত প্রায়।
৩ এপ্রিল অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটের কথা রয়েছে। তার তিন দিন আগে বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে আবেগপ্লুত ভাষণ দেন ইমরান। বলেন, তিনি একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘ষড়যন্ত্রকারী'দের কাছে পারছেন না।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর অনেকবার হুমকি চিঠি পেয়েছেন বলে ভাষণে জানান ইমরান খান। তিনি বলেন, ‘এগুলো সব বিদেশি ষড়যন্ত্র।’
বক্তব্যের এক ফাঁকে ইমরান তার পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে জনতাকে দেখিয়ে দাবি করেন, সরকারকে পতনের জন্য একটি ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ তৈরির প্রমাণ এটি। তবে গণমাধ্যমকে সেই নথি দেখাননি ইমরান খান।
যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ
ভাষণের এক পর্যায় মুখ ফসকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করে ফেলেন ইমরান খান।
তিনি বলেন, ‘আজ এখানে এসেছি কারণ ৮ বা ৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলাম। এটি একটি স্বাধীন দেশ ও সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ছিল।
‘তারা আগে থেকেই জানত যে একটি অনাস্থা প্রস্তাব আসছে। তখন অনাস্থা প্রস্তাবও জমা দেয়া হয়নি। এর মানে তারা (বিরোধীরা) বিদেশিদের সঙ্গে মিলে এই কাজ করছে। ভিনদেশিরা বলেছিল, তারা পাকিস্তানের প্রতি ক্ষুব্ধ। এটা আসলে একটা অজুহাত।
‘তারা (বিদেশিরা) জানিয়েছিল, ইমরান খান অনাস্থার পদক্ষেপে হেরে গেলে তারা পাকিস্তানকে ক্ষমা করে দেবে। যদি পদক্ষেপ ব্যর্থ হয় তবে পাকিস্তানকে একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।’
ইমরান বলেন, ‘যেদিন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলাম, সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে স্বাধীন। যার মানে এটা হবে পাকিস্তানিদের জন্য। এর মানে এই নয় যে আমরা শত্রুতা চেয়েছিলাম। যখন সরকার গঠন করি তখন জানিয়েছিলাম, যেসব পররাষ্ট্রনীতি আমাদের পক্ষে নয়, সেগুলো থেকে সরে আসব।’
রাশিয়া সফর নিয়ে যা বললেন
সম্প্রতি রাশিয়া সফর প্রসঙ্গে ইমরান বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রদূত তাদের (যুক্তরাষ্ট্রকে) বলেছিলেন যে রাশিয়া সফরের সিদ্ধান্তটি পরে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা তা মানতে নারাজ। তারা বলছে, এটি কেবল ইমরান খানের কারণে হয়েছে। তিনি থাকলে আমাদের সম্পর্ক ভালো হতে পারে না। তারা আসলে যা বলছে তা হলো, ইমরান খানের স্থলাভিষিক্ত যিনি হবেন তার সঙ্গে তাদের কোনো সমস্যা নেই।’
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলার দিন যখন পশ্চিমা দেশগুলো যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক অবরোধের ঘোষণা আসছিল, সেদিনই ইমরান খান দেশটিতে দুই দিনের সফরে যান। বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির পরিকল্পনা করে এই সফরের কথা জানানো হলেও কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসেনি।
আবেগী কথাবার্তা
কীভাবে নানা চড়াই-উৎরাই পাশ কাটিয়ে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন তার ব্যাখ্যাও দেন ইমরান খান।
তিনি বলেন, ‘আজ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলতে হবে। আমি সরাসরি এই আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছি কারণ এই মুহূর্তে আমাদের সামনে দুটি পথ রয়েছে।
‘তবে তার আগে আপনাদের বলতে চাই, কেন আমার মতো একজন ব্যক্তি রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। আমি একজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যাকে আল্লাহ খ্যাতি ও সম্পদ সবকিছু দিয়েছিলেন। আমি সেই প্রথম প্রজন্মের যারা একটি স্বাধীন দেশে জন্মগ্রহণ করেছি।
‘বয়সে পাকিস্তান আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়। আমার বাবা-মা দাসত্বের সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তারা আমাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিলেন যে আমি ভাগ্যবান। কারণ, আমি স্বাধীন দেশে জন্ম নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমি রাজনীতিতে প্রবেশ করেছি কারণ আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে পাকিস্তান কখনই সেই দেশ হতে পারে না যার স্বপ্ন আল্লামা ইকবাল দেখেছিলেন। যার জন্য অসুস্থ অবস্থায় লড়াই করেছিলেন কায়েদ-ই-আজম। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া, যা মদিনা রাজ্যের সঙ্গে যায়।
‘যখন রাজনীতি শুরু করি, তখন আমি আমার দলের ইশতেহারে তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। ন্যায়বিচার, যার অর্থ শক্তিশালী আইন; যা সবার জন্য সমান। দ্বিতীয়টি হলো মানবতা। কারণ একটি ইসলামী রাষ্ট্রে দয়া থাকতে হয়। শেষ কারণ আত্মসম্মান। একটি মুসলিম জাতি কখনও কারও গোলাম হতে পারে না।’
সৃষ্টিকর্তা তার পাশে ছিলেন- এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন ইমরান খান। বলেন, ‘আল্লাহ যদি আমাকে আশীর্বাদ না করতেন তবে আমি রাজনীতিতে আসতাম না।
‘আমাকে ১৪ বছর উপহাস সহ্য করতে হয়েছে। রাজনীতিতে কেন এসেছি সেই প্রশ্নের মুখে পরেছি বারবার। আজকে আমি আপনাদের বলতে চাই, একটি আদর্শের কারণে রাজনীতিতে আমার আসা।’
প্রধানমন্ত্রী বুধবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন বলে আশা করা হয়েছিল। তবে কোনো কারণ না দেখিয়ে ঠিকানা স্থগিত করা হয়। আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও এমকিউএম-পি এবং বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি) উপস্থিত ছিল না।
অনাস্থায় পরাজয় নিশ্চিতপ্রায়
পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব ওঠার পর প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানো ইমরান খানের জন্য সময়ের ব্যাপার হয়ে গেছে। এরই মধ্যে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন জোট সঙ্গী মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট এমকিউএম-পির নেতা ফারুগ নাসিম ও আমিনুল হক।
সরকারে থাকতে পার্লামেন্টে যত ভোটের প্রয়োজন, সেটি নিশ্চিত করা যখন কঠিন হয়ে যাচ্ছে, তখন এমকিউএম-পি ইমরানকে দিল কঠিন ধাক্কা। ইমরানের জোট ছেড়ে যোগ দিয়েছে বিরোধী শিবিরে।
জোটসঙ্গীর এমন অবস্থানে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের আগেই পদ হারানোর বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে। অলৌকিক কিছু না ঘটলে উত্তরসূরিদের পরিণতি বরণ করে নিতে হতে পারে ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরান খানকে। আগামী ৩ এপ্রিল অনাস্থা ভোট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মন্ত্রিসভায় ভাঙন
জোট সরকারের অন্যতম সঙ্গী এমকিউএম-পি। দলটির নেতা ফারুগ নাসিম এবং আমিনুল হক ইমরান খান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। নাসিম ছিলেন আইনমন্ত্রী। পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছেন, এমকিউএম-পি আহ্বায়ক খালিদ মকবুল সিদ্দিকীর নির্দেশে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
আমিনুল হক ছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিকম মন্ত্রীর দায়িত্বে। পদত্যাগপত্রে তিনি জানিয়েছেন, দলের প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই পদ ছাড়ছেন।
পার্লামেন্টে ভোটের হিসাব-নিকাশ
নিম্নকক্ষে ৩৪২ আসনের মধ্যে বিরোধীদের দখলে আছে ১৬৩টি। বাকি ১৭৯ আসন। এর মধ্যে ইমরানের দলের আছে ১৫৫টি, চার জোটসঙ্গীর ২০টি।
পিটিআইয়ের বেশ কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য এরই মধ্যে প্রকাশ্যে ইমরানের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছেন।
এ ছাড়া বুধবার ইমরান সরকারের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়া মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম-পি)-এর ৭ এবং বালুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি)-এর ৫ আসন রয়েছে। সমর্থন প্রত্যাহারকারী জামহুরি ওয়াতন পার্টির রয়েছেন এক সদস্য। পিএমএল-কিউ-এর সদস্য ৫।
এই পরিস্থিতিতে গদি বাঁচাতে মরিয়া ইমরান সোমবার পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী উসমান বুজদারকে সরিয়ে জোট সঙ্গী পিএমএল-কিউ-এর চৌধুরী পারভেজ এলাহীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। কিছুদিন আগেও ইমরান সরকারের জোট ছেড়ে বিরোধী দলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন চৌধুরী পারভেজ এলাহী।