বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের কারণে মিয়ানমারের নবনিযুক্ত বিমান বাহিনীর প্রধানসহ সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাদের এবং দেশটির সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসায় জড়িতদের লক্ষ্য করে নতুন সমন্বিত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাগুলো মিয়ানমারের তিনজন অভিযুক্ত অস্ত্র ব্যবসায়ীর পাশাপাশি তাদের সঙ্গে যুক্ত সংস্থা এবং অস্ত্র ব্যবসায়ী টেয় জাওয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা দুটি ব্যবসাকে লক্ষ্য করে দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সরকার দেশটির ৬৬ ইনফ্র্যান্টি ডিভিশনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মিয়ানমারের এই সেনা ডিভিশনের বিরুদ্ধে গত বছরের ক্রিস্টমাস ইভে দক্ষিণ-পূর্ব কায়াহ স্টেটে ৩০ জনকে গাড়িতেই জীবন্ত পুড়িয়ে মারার অভিযোগ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘জান্তা সরকারের ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও তাদের দ্বারা সঙ্ঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বার্মার জনগণের প্রতি আমাদের দৃঢ় সমর্থন দেখানোর জন্যই এই পদক্ষেপ নিয়েছি (নতুন নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত)।'
তিনি আরও বলেন, ‘সামরিক শাসন ও এর সমর্থকদের ওপর আমরা নিষেধাজ্ঞা দিতে থাকব যতক্ষণ না তারা সহিংসতা বন্ধ করে ও বার্মার জনগণকে গণতন্ত্রের পথ ফিরিয়ে দেয়।’
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র যুক্তরাজ্যও মিয়ানমারের বিমান বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করে এমন সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। মিয়ানমারের বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে বেসামরিক গ্রামে বোমা বর্ষণ করে হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করার অভিযোগ রয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছেন দেশটির নবনিযুক্ত বিমান বাহিনীর প্রধান জেনারেল হুতুন অং-ও। তিনি শুধু বিমান বাহিনীর প্রধানই নন, একই সঙ্গে মিয়ানমারের কংলোমোরেট ইকোনমিক হোল্ডিংস লিমিডেটের একজন পরিচালকও।
যুক্তরাজ্যের এশিয়াবিষয়ক মন্ত্রী আমান্ডা মিলিং এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া জনগণের ওপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা বন্ধ করার কোনো লক্ষণ দেখায়নি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহে সহায়তা করাই এই নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তু।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাজ্য সমমনা দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সব সময় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, আইনের শাসনের অধিকার রক্ষায় কাজ করবে এবং দমনমূলক যেকোনো শাসনব্যবস্থাকে জবাবদিহির আওতায় আনার কাজ করবে।’
কানাডাও মিয়ানমারের বিমান বাহিনীর প্রধান হুতুন অংসহ চার ব্যক্তি ও দুটি সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে।
গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী। অভ্যুত্থানের শুরুতেই মিয়ানমারের ডিফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সুচিকে আটক করা হয়। পরবর্তী সময়ে দেশটিতে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে জান্তা সরকার আন্দোলনকারীদের দমনে কঠোর ও নির্মম অভিযান পরিচালনা করে আসছে।
এর আগে সোমবার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো বর্বরোচিত সহিংসতাকে ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনটাই জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন।
গত সোমবার ওয়াশিংটন ডিসির ইউএস হলোকস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ব্লিঙ্কেন এ ঘোষণা দেন।
২০১৭ সালের পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিশ্বের শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের কাছ থেকে এ রকম একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পক্ষে দাবি জানিয়ে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাদের ভয়াবহ সহিংসতা থেকে বাঁচতে কমপক্ষে আট লাখ মানুষ বাংলাদেশ, ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়।
এর পরপরই মিয়ানমার শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনার সুপারিশ ও দাবি জানায় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন শক্তিধর দেশ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
অবশেষে গণহত্যার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থান ও বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন সুস্পষ্ট ঘোষণা মিয়ানমার সেনাদের বিচারের আওতায় আনার সম্ভাবনাকে ফের জাগিয়ে দিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাৎসি বাহিনীর গণহত্যার শিকার মানুষের স্মরণে হলোকস্ট মিউজিয়ামে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন আরও বলেন, ‘মিয়ানমার সেনারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়েছে। এমন বর্বরতাকে পরিমাপ করতে আবারও প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে হোয়াইট হাউসের পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটর ও সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির সদস্য জেফ মার্কলে বলেন, ‘অবশেষে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো সহিংস ঘটনাগুলোকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করায় জো বাইডেন প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই। যদিও এই ঘোষণা আরও অনেক আগে আসা উচিত ছিল। তবুও এই ঘোষণা মিয়ানমারের নির্দয় শাসকগোষ্ঠীকে জবাবদিহির আওতায় আনার পথে কার্যকর ধাপ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’