২০১৮ সালে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে ভেলকি দেখানো ইমরান খান কি চার বছরের মাথায় নিজেই ভেলকি দেখার অপেক্ষায়?
চলতি বছরের শুরুতেও পাকিস্তানে সরকার পরিচালনায় ইমরান খানের অবস্থান নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। হঠাৎ করেই তার আসন টলমলে।
ব্রিটিশ রাজ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া দেশটির কোনো সরকার তার মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি। ইমরান খানের পরিণতিও কি সেই একই হতে যাচ্ছে- এই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে।
বিরোধী পক্ষ ইমরানের প্রতি অনাস্থার কথা জানিয়েছে পার্লামেন্টে। যে চারটি দল নিয়ে জোট গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি, তার তিনটিই বেঁকে বসার ইঙ্গিত দিয়েছে। এই অনাস্থায় আবার সাবেক ক্রিকেটারের নিজের দল তেহরিক-ই-ইনসাফেরও একটি অংশের সায় আছে।
শুক্রবার ভোটের আগে পার্লামেন্টের বাইরে ইমরান খান সরকার ও বিরোধী দলগুলো পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডাকায় সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে দেশ শাসনে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এনে গত ৮ মার্চ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেয় বিরোধী দলগুলো। শুক্রবার এ বিষয়ে ভোট হবে।
বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আছে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এবং বেনজির ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) মতো বড় দলগুলো।
পার্লামেন্টে ভোটের হিসাব-নিকাশ
নিম্নকক্ষে ৩৪২ আসনের মধ্যে বিরোধীদের দখলে আছে ১৬৩টি। বাকি ১৭৯ আসন। এর মধ্যে ইমরানের দলের আছে ১৫৫টি, চার জোটসঙ্গীর ২০টি।
অনাস্থা প্রস্তাবে টিকে থাকতে হলে ইমরান খানকে অন্তত ১৭২ সদস্যের সমর্থন পেতে হবে। এর মধ্যে তিন জোটসঙ্গী মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম-পি), পাকিস্তান মুসলিম লিগ-কায়েদ (পিএমএল-কিউ) এবং বালুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি) বিরোধী শিবিরে যোগ দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।
সঙ্গীরা বিপক্ষে গেলে এমনিতেই ইমরানের প্রধানমন্ত্রী থাকা হবে না। তার ওপর নিজ দলের ২০ জনের বেশি এমপি ইমরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
ইমরানের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী পাকিস্তান মুসলিম লিগ (কিউ) প্রধান পারভেজ এলাহি বলেন, ‘অনাস্থা ভোটে জোটসঙ্গীদের হারাতে পারে তেহরিক-ই-ইনসাফ। ইমরানের চার জোটসঙ্গীর ২০ আসন রয়েছে পার্লামেন্টে।
‘তাদের ছাড়া নিম্নকক্ষে ইমরানের আসন আছে ১৫৫। ক্ষমতায় টিকে থাকতে তার আরও ১৭ ভোট প্রয়োজন।’
পারভেজ এলাহি নিজেও বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যোগ দিতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে।
আগেও হয়েছিল অনাস্থা ভোট
দুর্নীতির দায়ে নওয়াজ শরিফ অভিসংশিত হওয়ার পর ২০১৮ সালে চার দলের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন ইমরান খান। তিন বছরের মাথায় গত মার্চে অনাস্থা ভোট হয় ইমরানের বিরুদ্ধে। সেবার সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় অনায়াসেই উতরে গিয়েছিলেন তিনি।
সংঘাতের আশঙ্কা
অনাস্থা ভোটের আগে ইমরান খান সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভোটে যা-ই হোক, পদত্যাগ করবেন না তিনি। আর তার এই ঘোষণার কারণে দেশটির রাজনীতি সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ আশঙ্কার কথা জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই পরিস্থিতি ভয়াবহ সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। সরকারের দায়িত্ব সংবিধান অনুসরণ করা, কোনো হুমকি বা সহিংসতা ছাড়াই অনাস্থা প্রস্তাবে ভোটের আয়োজন করা।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি?
পাকিস্তানের রাজনীতিতে দেশটির সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বারবার। দেশটির ক্ষমতা বারবার দখল করেছে বাহিনীটি। বলা হয়ে থাকে, যখন বেসামরিক সরকার থাকে, তখনও সেনাপ্রভাব থাকে ব্যাপক। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যাওয়ার সুযোগ খুবই কম।
গত নির্বাচনে ইমরান খানের বিস্ময়কর উত্থানের পেছনে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে সেনা সমর্থনের বিষয়টি। তবে তেহরিক নেতা কখনও স্বীকার করতে চাননি। তার দাবি, জনগণই তাকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে।
ইমরানের মসনদ টলমলে হওয়ার পেছনে সেনাবাহিনীর সমর্থন প্রত্যাহারকেই সামনে এনেছে ভারতের দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। তাদের এক প্রতিবেদনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে ইমরান খানের।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) পরবর্তী মহাপরিচালক পদ নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে ইমরান সরকারের।
আইএসআইয়ের নতুন মহাপরিচালক পদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আঞ্জুমকে নিয়োগ দিয়েছেন ইমরান খান, নভেম্বরে দায়িত্ব নেবেন তিনি। এই সিদ্ধান্ত নিতে তাকে এক মাসেরও বেশ সময় নিতে হয়েছিল।
নানা ইস্যুতে বিতর্কিত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন আঞ্জুম। লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি ধরা হয়।
অতীতের সরকারপ্রধানদের পরিণতি
পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রী আজ পর্যন্ত মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। কেউ হত্যার শিকার হয়েছেন, কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে আবার কেউ হয়েছেন অভিসংশিত। মাঝেমধ্যেই দেশটিতে সেনা অভ্যুথানও দেখা গেছে।
পাকিস্তান জন্মের ৬৫ বছরে এ পর্যন্ত ২২ জন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ বছর শাসন করা হয়নি কারও।
২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসা ইউসুফ রাজা গিলানি যখন মেয়াদ পূর্ণ করবেন বলে আলোচনা ওঠে, সে সময় আচমকা সরে যেতে হয় তাকে। দেশটির সর্বোচ্চ আদালতে তিনি প্রধানমন্ত্রী অযোগ্য ঘোষণার পর ৪ বছর ৮৬ দিনের মাথায় ক্ষমতা ছাড়তে হয়।
গিলানির আগে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থেকেছেন দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ৪ বছর ৬৩ দিন।
২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসা নওয়াজ শরিফকে সেনাবাহিনী ক্ষমতাচ্যুত করে ৪ বছর ৫৩ দিনের মাথায়।
দেশটিতে সরকার কতটা ভঙ্গুর হতে পারে সেটি দেখা গেছে ১৯৫৭, ১৯৭১, ২০০৪ এবং ২০১৭ সালে।
১৯৫৭ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় ছিলেন কেবল ৬০ দিন, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ১৩ দিন, ২০০৪ সালে ৫৭ দিন এবং ২০১৭ সালে ৩০৩ দিন।
২০১৮ সালের ২০ আগস্ট সরকার গঠন করা ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রিত্বের বয়স এখন পর্যন্ত ৩ বছর ৭ মাস।