ইউক্রেনের যুদ্ধ বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতিতে বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে মন্তব্য করেছেন সার উৎপাদনকারী বিশ্বের অন্যতম বড় কোম্পানি ইয়ারা ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ভেইন টর হোলসিথার। তার মতে, ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সারের সংকটের কারণে এই বিপর্যয় ঘটতে পারে।
হোলসিথার বলেছেন, ‘সার ব্যবহারের সুবাদে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীর চাহিদার সমপরিমাণ বাড়তি খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। যদি কিছু ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় সারের যোগান দেয়া না যায়, তাহলে খাদ্য উৎপাদন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমার কাছে এটি মূলত বিশ্ব খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে কি না সেই প্রশ্ন নয়, বরং এই সংকট কত বড় হতে পারে সেটাই ভাববার বিষয়।’
সোমবার যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে ইয়ারা ইন্টারন্যাশনালের ব্যবসা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি তাদের সার উৎপাদনের কাঁচামালের জন্য অনেকাংশেই রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল।
ইতোমধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ায় সারের দামও বাড়ছে।
হোলসিথারের মতে, এই পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। পরিস্থিতি প্রতি ঘণ্টায় বদলে যাচ্ছে।
রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই দেশই বিশ্বের অন্যতম খাদ্য ও কৃষিজ পণ্য উৎপাদনকারী। রাশিয়াতে পটাশ ও ফসফেটের মতো সার তৈরির প্রধান উপাদানগুলোও বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত হয়।
ভেইন টর হোলসিথার বলেন, ‘আমরা যুদ্ধের আগে থেকেই একটা কঠিন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। এখন সাপ্লাই চেইন বাড়তি বাধার মুখোমুখি হচ্ছে। উত্তর গোলার্ধে এই মৌসুমে বিপুল পরিমাণ সার দরকার। আর চলমান এই যুদ্ধের প্রভাব সার সরবরাহেও পড়বে।’
ইউক্রেনের ভাসিলকিভ শহরে রাশিয়ার মিসাইল হামলায় বিধ্বস্ত ভবনের সামনে এক নারী। ছবি: এএফপি
রাশিয়ার ওপর আরোপ করা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব নরওয়ের কোম্পানি ইয়ারার ওপর সরাসরি পড়েনি। তবে জাহাজ চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কোম্পানির সার উৎপাদন ও সরবরাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ইতোমধ্যে দেশের সার উৎপাদনকারীদেরকে রপ্তানি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে রাশিয়া।
হোলসিথার জানান, ইউরোপে খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সারের প্রায় এক-চতুর্থাংশই আসে রাশিয়া থেকে। রাশিয়া থেকে রপ্তানি বন্ধ হলে সারের দাম বাড়তে পারে। একই সঙ্গে কমে যেতে পারে খাদ্য উৎপাদন। এর ফলে খাদ্যের দাম আরও বাড়বে।
অ্যামোনিয়া সার উৎপাদনের জন্য নাইট্রোজেনসহ বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রয়োজন হয়। ইউরোপে নিজেদের উৎপাদন কেন্দ্রে রাশিয়া থেকে আনা গ্যাস ব্যবহার করে ইয়ারা।
গত বছর গ্যাসের দাম বাড়ায় সাময়িকভাবে উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ সার তৈরিতে বাধ্য হয়েছিল কোম্পানিটি।
জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি, পটাশের অন্যতম সরবরাহকারী বেলারুশের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে গত বছর সারের দাম বেড়েছিল। একইসঙ্গে বেড়েছিল খাদ্যের দামও।
হোলসিথার মনে করেন, সংকট সামলাতে চাইলে বিশ্বকে খাদ্যের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকায় ঢাকায় টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে ক্রেতার ভিড় বাড়ছে। ছবি: সাইফুল ইসলাম
জলবায়ু পরিবর্তন ও বাড়তি জনসংখ্যার কারণে এমনিতেই বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থা চাপের মুখে ছিল। পরে করোনা মহামারি শুরু হওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে।
ইয়ারার প্রধানের মতে, ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে গরিব দেশগুলোতে খাদ্য সংকট আরও তীব্র হবে। এটিকে তিনি এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বলে মনে করছেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে গত দুই বছরে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি বেড়েছে। তাই এই নতুন বিপর্যয় সত্যিই উদ্বেগের।’
স্বঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্র দোনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিক (ডিপিআর) ও প্রতিবেশী লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিককে (এলপিআর) রক্ষার কথা বলে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ২০১৪ সালে কিয়েভে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয় অঞ্চল দুটি।
হামলার যুক্তি হিসেবে রাশিয়ার পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, দেশটি চায় ইউক্রেনের ‘অসামরিকায়ন’ ও ‘নাৎসিমুক্তকরণ’।
অপরপক্ষে ইউক্রেন বলছে, সম্পূর্ণ বিনা উসকানিতে রাশিয়া হামলা চালিয়েছে। দেশটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে আসছে।