ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হয় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। ধারণা করা হচ্ছিল, সুপারপাওয়ার রাশিয়া এক নিমিষেই কবজা করে ফেলতে পারবে প্রতিবেশী দেশটিকে। তবে প্রায় দুই সপ্তাহ পরও তা ঘটেনি। শক্তিশালী রুশ বাহিনী ১২ দিনেও ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের দখল নিতে পারেনি।
এই অবস্থায় ইউক্রেন অভিযান নিয়ে কপালে ভাঁজ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। এটা এখন মোটামুটি নিশ্চিত, ইউক্রেনে দীর্ঘায়িত হচ্ছে রুশ অভিযান।
কেন এমনটি হলো? রাশিয়ার সেনাদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনিয়ানদের প্রতিরোধ, পশ্চিমা বিশ্বের করা অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রই কি থমকে দিয়েছে রুশ অগ্রগতি?
বিশেষজ্ঞরা মোটেই সেটা ভাবছেন না, বরং এমন প্রকৃতি বলতে গেলে এক অভেদ্য দেয়াল তৈরি করেছে রুশ সেনাবহরের সামনে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কিংবা তাদের সামরিক জোট ন্যাটোর চোখ রাঙানি নয়, রুশ বাহিনীর সামনে আতঙ্ক হয়ে এসেছে ইউক্রেনের বসন্ত।
পূর্ব ইউরোপে এ সময়টি রাসপুতিৎসা নামে পরিচিত। রাসপুতিৎসা বছরে আসে দুবার; শরৎকালে যখন বৃষ্টি হয়, আর বসন্তে যখন তুষার গলে যায়। এ সময় কাঁচা রাস্তা ভরে যায় গভীর ও আঠালো কাদায়। তখন সাধারণ যানবাহন তো দূরের কথা, শক্তিশালী ট্যাংকও চলার ক্ষমতা হারায়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই আবহাওয়া-শক্রুর আক্রমণ থেকে রাশিয়াকে রক্ষা করেছে। মোঙ্গলদের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর পরাজয়েরও অন্যতম কারণ ছিল পূর্ব ইউরোপের এই বৈরী আবহাওয়া।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার বাহিনী এমন বিপর্যয়ে পড়েছিল। ছবি: সংগৃহীত
তবে এবার ইউক্রেনে সেই রাসপুতিৎসাই নাকাল করছে পুতিন বাহিনীকে। ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে তাই যতটা সম্ভব রাসপুতিৎসাকে এড়িতে চলার কৌশল নিচ্ছে মস্কো।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের রোস্তভ অঞ্চলে কাদামাটিতে এক সপ্তাহ ধরে ট্যাংক নিয়ে নাজেহাল রুশ সেনারা। টি-৭২ মডেলের ট্যাংকগুলো আটকে আছে গভীর কাদায়। পরিস্থিতি এতটায় খারাপ যে, সেগুলো টেনে তুলতে বিশেষ খননযন্ত্র আনতে বাধ্য হয়েছে রুশ সেনারা।
ইউক্রেন অভিযানে রুশ বাহিনীর বড় বাধা বৈরি আবহাওয়া। ছবি: সংগৃহীত
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন সীমান্ত থেকে কিছু সেনা সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয় মস্কো। আমেরিকার দাবি, সে সময়ে ইউক্রেনে বফর গলা সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। অর্থাৎ প্রাকৃতিক পরিস্থিতির কারণেই তখন পিছু হটেছিলেন পুতিন।
সাঁজোয়া যানের বহর বিপদে
আমেরিকান ওয়েবসাইট টাস্ক অ্যান্ড পারপাস বলছে, টি-৯০ ট্যাংকসহ (এমবিটি) রাশিয়ার যুদ্ধাস্ত্রগুলো আমেরিকা ও ন্যাটোর অস্ত্রের তুলনায় হালকা। পূর্ব ইউরোপের আবহাওয়ার মধ্যে অভিযান চালানোর জন্য এমন নকশা করা হয়।
রাশিয়ার টি-৯০ ট্যাংকের ওজন প্রায় ৪৬ টন, যেখানে আমেরিকার এম-১ আব্রামসের ওজন ৫৪ টন; জার্মানির লেপার্ড ২এ৬ ট্যাংকের ওজন ৬২ টন।
বিশাল বহর নিয়ে কিয়েভের দিকে এগুচ্ছে রুশ বাহিনী। ছবি: সংগৃহীত
আমেরিকান সাময়িকী ফরেন পলিসিকে চলতি মাসের শুরুতে দেয়া সাক্ষাৎকারে রুশ প্রতিরক্ষাবিষয়ক গবেষক দারা ম্যাসিকট দাবি করেন, ‘সব ধরনের আবহাওয়ায় লড়াই চালিয়ে যেতে রুশ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বছরজুড়েই তারা নানা মহড়ায় ব্যস্ত থাকে। তাই কাদায় খুব একটা বেগ পেতে হবে না রুশ বাহিনীকে।’
রাশিয়ান সামরিক বিশ্লেষকরাও এমন দাবি করে আসছেন। তারা বলছেন, আধুনিক ইউক্রেনে ১৯৪১ সালে নাৎসি আগ্রাসনসহ অতীতের সব আক্রমণের সময় যেসব রাস্তা ছিল, সেগুলোর বেশির ভাগ এখন পাকা। তাই রাস্তা কোনো বিষয় না।
তবে বাস্তবে তেমনটি ঘটছে না। এ সপ্তাহের শুরুতে কিয়েভমুখী ৪০ মাইল দীর্ঘ রুশ সামরিক কনভয় দেখা গেছে। তবে নতুন করে পাওয়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কাদামাটি ও সাঁজোয়া যানের টায়ার রক্ষণাবেক্ষণে ঘাটতির কারণে বহরটি সম্ভবত থমকে গেছে।
যুক্তরাজ্যের দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘সাম্প্রতিক দিনগুলোয় অগ্রসরমাণ রুশ সেনাদের সামান্য অগ্রগতি দেখা গেছে। তাদের এই ধীরগতির পেছনে যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণে ঘাটতি, কাদা ও জ্বালানির অভাবকে দায়ী করা হচ্ছে।’
ব্রিটিশ ও আমেরিকান গোয়েন্দারা মনে করছেন, মরণ কামড় দিতে তৈরি ইউক্রেনিয়ানদের সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘রাসপুতিৎসা’। এটি সেনাবহরটির চলার পথ আরও দুর্গম করে তুলেছে।
কাদামাটিতে আটকে গেছে রুশ ট্যাংক। ছবি: সংগৃহীত
অনলাইনে প্রচারিত কিছু ছবিতে কাদায় আটকে যাওয়ার পর পরিত্যক্ত রুশ সাঁজোয়া যান দেখা গেছে। কিছু পত্রপত্রিকা লিখেছে, পরিবর্তিত আবহাওয়া বিশাল কনভয়টিকে রাস্তায় আটকে থাকতে বাধ্য করছে।
যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট ফোর্সেস কমান্ডের সাবেক কমান্ডার জেনারেল স্যার রিচার্ড ব্যারনস বিবিসি রেডিও ফোরের টুডে অনুষ্ঠানে বলেন, প্রমাণগুলো থেকে বোঝা যায়, কনভয়টি কাদায় এমনভাবে আটকে গেছে যে, সেগুলোকে সরিয়ে নেয়াও কঠিন।