রাশিয়া ও চীন নিজেদের বিভেদ পাশে সরিয়ে রেখে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে তুলেছে মজবুত এক জুটি। লক্ষ্য কয়েক দশক ধরে বিশ্বে আমেরিকার একক কর্তৃত্ব খর্ব করা।ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের একটি প্রকাশ্য রূপ বলে মনে করছেন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে শুধু চীনকে ঠেকিয়ে রাখার কৌশলে মনোযোগ দিয়েছে। এর মাঝে রাশিয়া-চীন ঐক্য টালমাটাল পরিস্থিতিতে ফেলেছে বাইডেন প্রশাসনকে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধ অবলম্বনে লিখেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি নতুন গতিপথ তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম বড় কোনো সংঘাত। দুটি প্রধান বিশ্বশক্তি এখন আমেরিকার একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে লড়ছে।
কোল্ড ওয়ার বা শীতল যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও তার জোট যে অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিল, তার তুলনায় এবারের চ্যালেঞ্জ আলাদা।
আমেরিকান কর্তৃত্ব কমাতে রাশিয়া ও চীন দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের ভিত্তিতে একটি মজবুত জুটি গড়ে তুলেছে। এই সম্পর্ক মোটেই ১৯৫০-এর দশকের চীন-সোভিয়েত ব্লকের মতো নয়। রাশিয়া এখন ইউরোপে গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস সরবরাহকারী দেশ। চীনও দরিদ্র, যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো দেশ নয়, বরং তারা এখন বহুমাত্রিক সামরিক সক্ষমতা ধারণের পাশাপাশি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পণ্য উৎপাদন শক্তির দেশ।‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ এর নামে বৃহস্পতিবার ইউক্রেনে বিশাল সেনাবাহিনী পাঠানোর পর ভ্লাদিমির পুতিন পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ইউরোপের সামনে কোল্ড ওয়ার পরবর্তী নিরাপত্তাব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের দাবি তুলেছেন। তিনি এটাও দেখিয়েছেন, পশ্চিমা আপত্তি ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পরোয়া না করে রাশিয়া এখন নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়ার মতো সামরিক সক্ষমতা রাখে। বেইজিং-মস্কোর সম্পর্কের ওপর আস্থা দেখাতে পুতিন চীন-রাশিয়া সীমান্ত থেকে সামরিক ইউনিট সরিয়ে নিয়েছেন। দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো জোট না থাকলেও এই দুটি শক্তি তাদের সুবিধার জন্য বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। এ উদীয়মান শক্তি ব্যবস্থা ভৌগোলিকভাবে যেসব অঞ্চলে আমেরিকার গভীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, সেখানে ওয়াশিংটনকে একই সঙ্গে দুই প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ে নামতে বাধ্য করছে। বাইডেন প্রশাসন এখন নিজেদের প্রাধান্য পুনর্বিবেচনা করা, সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি, মিত্রদের প্রতি আরও দায়বদ্ধ থাকার দাবি, বিদেশে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন এবং ইউরোপের মস্কো নির্ভরতা কমাতে বিকল্প জ্বালানির উৎস সন্ধানসংক্রান্ত বহুমুখী বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
সাবেক ওবামা সরকারের সময়ে পেন্টাগনের শীর্ষ নীতিনির্ধারক মিশেল ফ্লোরনয় বলেন, ‘আমরা সবাই ইউরোপকে সামগ্রিকভাবে মুক্ত ও চির শান্তির জায়গা হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। আমরা জানতাম, রাশিয়া একটা ছায়া যুদ্ধ চালাতে থাকবে এবং পুতিন তার কেজিবির বৈশিষ্ট্য অবলম্বন করে নিজস্ব পরিধিতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবেন। তবে একটি সার্বভৌম দেশের সরকার পুনর্গঠিত করার উদ্দেশ্যে পূর্ণমাত্রায় সামরিক হামলা চালানো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়।’তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেখছি, পুতিনের কৌশল বেইজিং পছন্দ না করলেও তারা পশ্চিমা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে মস্কোর সঙ্গে মিলেমিশে একটি কতৃর্ত্ববাদী শক্তি হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আরও দেখা যাবে।’স্নায়ুযুদ্ধের শেষ দিকে ওয়াশিংটনের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টার কারণে আমেরিকার দুর্দশা আংশিকভাবে বেড়েছে। বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে গণতন্ত্র ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি ক্রেমলিনের নেতৃত্বে ওয়ারশ চুক্তির অধীনে থাকা সদস্য দেশ ও কয়েকটি সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রকে ইউরোপের প্রধান সামরিক জোট ন্যাটোভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এটা ছিল মস্কোর কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হতে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর কয়েক দশকের পুরোনো আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন। তবে পুতিন বিষয়টিকে হার-জিতের খেলা হিসেবে নিয়েছেন। রাশিয়াকে তিনি সোভিয়েত আমলের অবস্থানে নিয়ে যেতে চান, যেখানে অধীন দেশগুলোর ওপর মস্কোর খবরদারি বজায় থাকবে।চীনের কমিউনিস্ট পার্টিও সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোতে গণতন্ত্রের আন্দোলনকে আমেরিকান প্লট হিসেবে দেখেছে। তাদের আশঙ্কা ছিল, একই কৌশল বেইজিংয়ের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা হতে পারে। এর প্রতিক্রিয়ায় চীন অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর ও সামরিক শক্তি দ্বিগুণ করেছে।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত করে আমেরিকার কর্তৃত্ব খর্ব করতে চায় চীন ও রাশিয়া। কার্টুন: সংগৃহীতএক দশক আগে শি চিনপিং দায়িত্ব নেয়ার পর এ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। হংকংয়ে গণতন্ত্রের পক্ষে আন্দোলন জোরদার হলে চিনপিং কঠোর নিরাপত্তা আইন জারি করেন। পাশাপাশি সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ ও আন্তর্জাতিক আর্থিক কেন্দ্রকে স্বায়ত্তশাসন দেয়ার চুক্তিগুলো তিনি বাতিল করে দেন।পেন্টাগন ২০১৫ সালে যাকে ‘মহাশক্তির প্রতিযোগিতার পুনরুত্থান’ বলে ঘোষণা দেয়- সেদিকে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আমেরিকান নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বিশেষভাবে নজর দিচ্ছে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান থেকে সরে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।ভবিষ্যৎ সংঘাতের জন্য পেন্টাগনের প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন বারবার চীনকে ‘অগ্রসরমান চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তবে রাশিয়াকে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য ততটা বিপজ্জনক ভাবা হয়নি। এটি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পরিকল্পনার সঙ্গেও মিলে যায়, যদিও তিনি বিশ্বের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে বারবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তিনি দায়িত্ব নেয়ার সময় ইরাক ও আফগানিস্তানে ব্যয়বহুল যুদ্ধের পর আমেরিকানদের জন্য একটি ‘মধ্যপন্থি’ বৈদেশিক নীতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মহামারি, অর্থনীতি এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোতে তার মনোযোগ দেয়ার কথা। মস্কোর সঙ্গে তার প্রশাসন সম্পর্ক বজায় রাখলে বেইজিংয়ের সঙ্গে সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতায় মনোনিবেশ করা যাবে বলে ধারণা ছিল বাইডেনের। হোয়াইট হাউসের ভাষায় একটি ‘স্থিতিশীল, অনুমেয়’ সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে বাইডেন গত জুনে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক সুরক্ষায় বাইডেন দূরপাল্লার আমেরিকান ও রাশিয়ান পারমাণবিক অস্ত্র সীমিত করে নতুন স্টার্ট চুক্তি (কৌশলগত অস্ত্র সীমিতকরণ চুক্তি) পাঁচ বছরের জন্য নবায়নে সম্মত হন। আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী হুমকির পুনরুত্থান ঠেকাতে হোয়াইট হাউস পেন্টাগনকে মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার ঘাঁটি ব্যবহারের নির্দেশও দেয়। ওয়াশিংটনের মনোযোগ অন্যদিকে থাকার সুবিধা নিয়েছেন পুতিন। তিনি বেলারুশ ও ইউক্রেনকে মস্কোর প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসার এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি আমেরিকার ইউরোপীয় মিত্রদের দোরগোড়ায় রাশিয়ার বিশাল সামরিক বাহিনী প্রস্তুত রেখেছেন এবং ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ করেছেন। আমেরিকার বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট ৭০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এখন তাদের সামনে জরুরি ভিত্তিতে মোকাবিলার জন্য রয়েছে রুশ সংকট। চীনা হুমকির প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যস্ত থাকা পেন্টাগনের জন্য এটি একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।সাবেক সামরিক ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা ২০১৮ সালে পেন্টাগনের জন্য একটি কৌশলগত গবেষণা পরিচালনা করেন। এতে বলা হয়, ‘আমেরিকান সামরিক বাহিনীকে একই সঙ্গে দুই বা ততোধিক ফ্রন্টে লড়াই করতে বাধ্য করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষভাবে পরাস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’সংকটের কারণে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে আরও সৈন্য পাঠিয়েছে। এটি দেশটিকে প্রতিরক্ষা ব্যয়ের মাত্রা এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর আকার পুনর্বিবেচনাকে প্ররোচিত করবে। চীনের বাড়তে থাকা পারমাণবিক সক্ষমতা কোনো অস্ত্র-নিয়ন্ত্রণ চুক্তির দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়ার শক্তিশালী পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার। এ দুটি একসঙ্গে আটকানোর জন্য আমেরিকার পারমাণবিক শক্তি কমানোর যুগের অবসান ঘটতে পারে।
রাশিয়া ও চীন উভয় দেশকে মোকাবিলা করার জন্য এখন বৈশ্বিক শক্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে নিজস্ব জোটগুলোর দিকে আরও বেশি ঝুঁকতে বাধ্য হবে বাইডেন প্রশাসন।
ইউক্রেনের শহর খারকিভে রাশিয়ার আক্রমণ। ছবি: এএফপিগত মাসের শুরুর দিকে পুতিন ও চিনপিং বেইজিংয়ে বৈঠক শেষে ৫ হাজার ৩০০ শব্দের একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। সেই বিবৃতির মূল লক্ষ্য ছিল ন্যাটো। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার অন্য দেশের সঙ্গে আমেরিকান জোটকেও ওই বিবৃতির লক্ষ্য করা হয়।
গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সমুদ্রপথ দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক ঘাঁটি শক্তিশালী করেছে চীন। দেশটি বিশ্বজুড়ে তাদের ঘাঁটিগুলোর নতুন নেটওয়ার্কও তৈরি করছে। এই নেটওয়ার্ক চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনফ্রাস্ট্রাকচার উদ্যোগের আওতায় নির্মিত বন্দর স্থাপনাগুলোকেও তাদের দ্রুত সম্প্রসারমাণ নৌবাহিনীর জন্য ব্যবহারের সুবিধা তৈরি করবে। যুক্তরাষ্ট্র ইকুয়েটরিয়াল গিনিকে চাপ দেয়ার মাধ্যমে চীনা নৌবাহিনীর অগ্রগতির সীমা আটলান্টিকে পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশল স্টাডিজ থিংক ট্যাংকের সামরিক ইতিহাসবিদ এলিয়ট কোহেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে একই সঙ্গে একাধিক ফ্রন্টে কাজ করার জন্য আবারও অভ্যস্ত হতে হবে। তা শুধু সামরিকভাবে নয়, মানসিক ও পররাষ্ট্রনীতি তৈরির দিক থেকেও ঘটতে হবে।’বাইডেন প্রশাসন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টার মধ্যে পেন্টাগন জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল প্রকাশে সময় নিচ্ছে। এ কৌশলে থাকছে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঠেকানোর পরিকল্পনা ও কোন ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে হবে সে বিষয়ে নতুন পর্যালোচনা। এর মধ্যেই পেন্টাগনকে বেইজিং ও মস্কোর জোড়া চ্যালেঞ্জের দিকে সমান মনোযোগ দেয়া উচিত, নাকি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গুরুত্ব বাড়াতে হবে, তা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে আমেরিকান প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। সামরিক ইস্যু ছাড়াও মস্কোর সঙ্গে নতুন সংঘাত অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ভাঙনগুলোকে ত্বরান্বিত করতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির সরবরাহ উন্মুক্ত করার চেষ্টা করছে। পশ্চিমারা রাশিয়ান ব্যাংক ও বড় কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে মস্কো বেইজিংয়ের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে। বেইজিং এরই মধ্যে একটি ডিজিটাল মুদ্রা ছেড়েছে এবং পশ্চিমের থেকে আলাদা একটি আর্থিক বিনিময় ব্যবস্থাপনা তৈরি করছে।রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে ইউরোপকে। গত বছর ইউরোপের প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজারের ২৯ শতাংশ রাশিয়ার দখলে ছিল। এই কারণে জ্বালানিও জাতীয় নিরাপত্তার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে।রিসার্চ ফার্ম আইএইচএস মারকিটের ভাইস চেয়ারম্যান ড্যানিয়েল ইয়েরগিন বলেন, ‘জ্বালানি নিরাপত্তার গুরুত্ব সম্পর্কে বেখেয়ালের বিষয়টির ইতি এরই মধ্যে ঘটেছে। এর অর্থ হলো ইউরোপের জন্য জ্বালানি উৎসের দিকে জোর দেয়া হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক জ্বালানি নীতিগুলো একটি নতুন চেহারা নিচ্ছে।’ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে জ্বালানিকে ব্যবহারের সমর্থকরা বলছেন, ওয়াশিংটনের এখন উচিত আমেরিকান তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং দেশটিতে নতুন এলএনজি রপ্তানি টার্মিনাল ও পাইপলাইন অনুমোদন করা। ইউরোপের বর্তমান সংকট ন্যাটোকেও নাড়া দিয়েছে। সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল ইয়েনস স্টলটেন বার্গের মতে, ‘ইউরোপীয় নিরাপত্তার নিউ-নরম্যাল’ মোকাবিলার জন্য জোটকে ঢেলে সাজাতে হবে। মিউনিখের এক নিরাপত্তা সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও অন্য নেতারা রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় অংশীদারদের ঐক্যের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।ন্যাটো কর্মকর্তাদের মতে, এর অর্থ হতে পারে স্বল্প সময়ের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে নতুন সমর বাহিনী পাঠানো এবং ন্যাটোর পূর্ব প্রান্তে পোল্যান্ড ও বাল্টিক রাজ্যে মিত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করা। ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত ন্যাটো-রাশিয়া ফাউন্ডিং অ্যাক্ট ন্যাটোকে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপীয় কোনো নতুন সদস্য দেশের ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েনের সুযোগ দেয় না। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই সমঝোতা বাতিল করা যেতে পারে।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সাম্প্রতিক এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, বেশির ভাগ ইউরোপীয় ইউক্রেন সংকটকে ইউরোপের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন।
বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা অবশ্য উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ইউরোপীয় জোটের সংহতি সামনের বছরগুলোতে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। কারণ বিপুল সামরিক ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক উঠবে এবং জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সামরিক সম্পর্ক নতুন সংঘাতের কারণ হতে পারে।
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে রাশিয়ার আক্রমণ। ছবি: এএফপিন্যাটো আগামী জুনে মাদ্রিদে জোটের নতুন ‘কৌশলগত ধারণা’ গ্রহণের পরিকল্পনা করছে, যা সামনের দশকে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিস্তৃত রূপরেখা দেবে। এটি সাবেক কর্মকর্তা ও অন্য বিশেষজ্ঞদের করা আলফেন গ্রুপের একটি প্রতিবেদন হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।
ওই ধারণাপত্রে প্রস্তাব করা হবে, জোটের ইউরোপীয় সদস্য ও কানাডা ২০৩০ সালের মধ্যে ন্যাটোর ন্যূনতম সামরিক প্রয়োজনীয়তার ৫০ শতাংশের জোগান দেবে, যাতে করে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে নিবৃত্ত করার দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারে।ন্যাটোতে আমেরিকার সাবেক দূত আলেক্সান্ডার ভার্শবাও বলেন, ‘সবাই এখন একত্রিত এবং রাশিয়ানরা যা করছে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে। তবে যখন আমরা ন্যাটোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতিতে যাওয়ার উদ্যোগ নেব এবং সম্ভাব্য পারমাণবিক বিষয়গুলোকে পুনর্বিবেচনা করতে নামব, তখন সবাই বিভক্ত হয়ে যেতে পারে।’