হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে তিনি চমকে ওঠেন। চারপাশে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেন। না, সবকিছু ঠিকঠাক। কিছু লোক আশপাশে ঘুরে জরিপ করছে।
স্বস্তি ফিরে পান ওই নারী। মনে পড়ে তিনি এখন ইউক্রেনে নেই। কিছুক্ষণ আগে সীমান্ত পেরিয়েছেন। এখন তিনি রোমানিয়ায়। স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের দেখভাল করছে, খাবার দিচ্ছে। বাস খুঁজে পেতে তাদের সাহায্য করছে দোভাষীরা। তিনি এখন নিরাপদ!
উত্তর-পূর্ব রোমানিয়ার সিরেট সীমান্তে এত ভিড় আগে দেখা যায়নি। রোমানিয়ায় যাওয়ার রাস্তায় এখন সারি সারি দোকান। খাবার, পানীয়, কাপড়সহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই সেখানে পাওয়া যাচ্ছে।
সীমান্তের জিরো পয়েন্ট থেকে ইউক্রেন অংশের সারিটি কয়েক কিলোমিটার লম্বা। শিশু, কিশোরী, নারী, বৃদ্ধ সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে অল্প কিছু মালপত্র। তাড়াহুড়ো কিংবা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, তাই যত কম সম্ভব মালপত্র বহন করছে তারা। বলতে গেলে প্রত্যেকের জীবন এখন একেকটি স্যুটকেসে বন্দি।
স্বদেশ বাঁচাতে ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় পরিবারের নারী সদস্যরা সন্তান নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন। অনেকে আবার একাই পালাচ্ছেন দেশ ছেড়ে।
গল্প: ১
৩৭ বছরের অ্যালোনা তার চার বছরের ছেলে ম্যাক্সকে নিয়ে কিয়েভ ছেড়েছেন। বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে প্রথম বিস্ফোরণের পর পরই শহর ছাড়েন তারা। রাস্তায় তীব্র যানজটে পড়েছিলেন। হাজার হাজার মানুষ এই পথ ধরে কিয়েভ ছেড়ে পালাচ্ছে।
রোমানিয়া সীমান্তঘেঁষা শহর চেরনিভতসিতে অ্যালোনার পরিবারের থাকে। পরিকল্পনা ছিল সেখান থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। কিন্তু উত্তেজনা বাড়তে থাকায় ফ্রান্সে যাওয়ার পরিকল্পনা আঁটেন অ্যালোনা। সেখানে তার এক বন্ধু আছে।
অ্যালোনা বলেন, ‘কিয়েভে আমার বাড়ির সামনের একটি ভবনে আঘাত হানে বোমা। জানি না, নিজের বাড়ির কী অবস্থা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, ইউরোপের একটি বড় শহরে বোমা হামলা হচ্ছে।’
গল্প: ২
মার্তা পোহোরিলা তার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে নিকার দিকে চেয়ে আছেন। ৭৮৯ কিলোমিটার দূরের ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের শহর খেরসন থেকে এসেছেন তারা। রোমানিয়ায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর ক্যালারাসিতে যাবেন।
মার্তা বলেন, ‘আমার মা-বাবা থাকেন ওডেসায় (ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের শহর)। তাদের জন্য ভয় পাচ্ছি। তারা বাঁচবে কি না জানি না। আমার ভাই সেনাবাহিনীতে আছে। আগেও সে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। ওর জন্য চিন্তা হচ্ছে।’
গল্প: ৩
১৬ বছরের লিওনিডেকে ইউক্রেন ছাড়তে বেগ পেতে হয়েছে তার মা-বাবাকে। মা ইন্নার সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে রোমানিয়ায় এসেছে সে। এখানে তার কিছু বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। বন্ধুরা তাকে স্পেনে নিয়ে যাবে। সেখানে একটি ইউক্রেনীয় পরিবারের সঙ্গে থাকবে লিওনিডেক।
পেশায় চিকিৎসক ইন্না বলেন, ‘আমি যাচ্ছি না। ডিনিপ্রোতে আমার মা-বাবা ও পোষা প্রাণীগুলোর যত্ন নিতে হবে। শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।’
গল্প: ৪
ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলের শহর চেরনিভসিতে থাকত ১৩ বছরের জনা। পরিবার ও আদরের দুটি কুকুর নিয়ে এখন নিরাপদ আশ্রয়ের অপেক্ষায় জনা। পরিকল্পনা আছে, ইতালিতে স্বজনদের কাছে যাবে তারা।
জনা বলে, ‘ইউক্রেনে শিশুরা লুকিয়ে থাকে। ভয়ে থাকে যেকোনো মুহূর্তে বাড়িঘর ভেঙে পড়তে পারে।’
গল্প: ৫
ভ্লাদার বয়স ১৮। ইউক্রেনের চেরনিভতসি শহরে থাকতেন। তার মা এবং দাদি ইতালিতে বাস করেন। তাই এখন সেখানেই যাচ্ছেন। তবে তার বাবা এবং তার দাদা-দাদি এখনও ইউক্রেনে আছেন।
ভ্লাদা বলেন, ‘আমি ইতালিতে থাকতে চাই না, আমি ফিরে যেতে চাই। আমার দেশকে সাহায্য করতে চাই। আশা করি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না।’
গল্প: ৬
২৮ বছর বয়সী ইনা তার তিন বছরের মেয়ে ভেরোনিকার সঙ্গে সীমান্তের কাছে বসে আছেন। তারা পশ্চিম-মধ্য ইউক্রেনের শহর ভিন্নিতসিয়ার বাসিন্দা। বাড়িঘর ফেলে ইতালিতে যাচ্ছেন। যেখানে ইনার মা ১০ বছর ধরে কাজ করছেন। স্বামীকে বলে এসেছেন, যুদ্ধ থামলে ফিরে আসবেন।
ইনা বলেন, ‘শুধু ইউক্রেনে নয়, গোটা বিশ্বে শান্তি চাই। যুদ্ধে সবকিছু নষ্ট হয়। দেখেন শিশুরা কাঁদছে। মৃত্যু দেখতে চাই না।’