পরাশক্তি রাশিয়ার সামরিক হামলা রুখে দিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কির প্রতিরোধ যুদ্ধ তাকে এনে দিয়েছে বিশ্বনেতার মর্যাদা।
দেশবাসীর কাছে ৪৪ বছর বয়সী জেলেনস্কি তাদের সব প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন।
গত বৃহস্পতিবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হামলার ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেনে সামরিক হামলা শুরু করে রাশিয়া। কয়েক দিনের মধ্যে রুশ সেনাবহর চারদিক থেকে রাজধানী কিয়েভ ঘিরে ফেললেও প্রাণভয়ে দেশ ছাড়েননি জেলেনস্কি।
পুতিন বাহিনীর প্রধান লক্ষ্য হওয়া সত্ত্বেও না পালিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের ঘোষণা দেন তিনি।
বলেন, ‘যুদ্ধ এখানেই হচ্ছে। আমাদের দরকার গোলাবারুদ। পালিয়ে যাওয়ার বাহন নয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জেলেনস্কির ফোনালাপের বরাত দিয়ে শনিবার এ কথা জানিয়েছেন আমেরিকার এক জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
এভাবেই বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নেন সাবেক এই কৌতুক অভিনেতা।
অভিনয় থেকে হঠাৎই রাজনীতিতে যাত্রা শুরু করেন জেলেনস্কি। তিনি শুরু থেকে রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। তার পরিবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে।
কৌতুক দিয়ে অভিনয়ে যাত্রা
আইনে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার পর নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে একটি কমেডিয়ান গ্রুপে যুক্ত হন জেলেনস্কি। দেশজুড়ে সংগঠনটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। সংগঠনের এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সফলতা পাচ্ছিলেন এই অভিনেতাও।
প্যাডিংটন ও প্যাডিংটন-২-এ তার অনবদ্য অভিনয় তাকে সফলতা এনে দেয়।
তবে ২০১৫ সালে ‘সার্ভেন্ট অফ দ্য পিউপিল’ নামের টেলিভিশন শো’তে তার অসামান্য অভিনয় তাকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এই ধারাবাহিকে তিনি অভিনয় করেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে। সেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার আপসহীন ও জোরালো বক্তব্য তাকে রাজনৈতিক জীবনে সফলতা অর্জনে সহায়তা করে।
চালু হওয়ার তিন বছরের মধ্যে এই ধারাবাহিকের সফলতা এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক দল উন্মোচনের শক্তি জোগায়। জেলেনস্কিও সেই দলে যোগ দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে তার সফল পদচারণা শুরু হয়।
২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয় লাভ করেন জেলেনস্কি। ৭৩ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে তখনকার প্রেসিডেন্ট পেট্রো পরোশেঙ্কোকে পরাজিত করেন জেলেনস্কি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা
জেলেনস্কির দাদা স্যামওয়োন ইভানোভিচ জেলেনস্কি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন।
ইহুদি ধর্মের জেলেনস্কির পরিবারের কয়েকজন সদস্য জার্মানির নাৎসি বাহিনীর চালানো হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার পর পরই তাই জেলেনস্কি তাদের পৈতৃক বাড়ি ক্রিভি রিহতে তার দাদার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে যান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর কাছে নাৎসি জার্মানির আত্মসমর্পণের দিনকে স্মরণ করে উদযাপিত ভিক্টরি ডে-তে দাদার কবরে শ্রদ্ধা জানান তিনি।
ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির সখ্য
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনালাপের কারণে অভিশংসনের শিকার হতে যাচ্ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনকে ফাঁসানোর জন্য জেলেনস্কিকে একাধিকবার ফোনে অনুরোধ করেছিলেন ট্রাম্প।
প্রাকৃতিক জ্বালানিসমৃদ্ধ ইউক্রেনের একটি প্রতিষ্ঠানে পরিচালক পদে ছিলেন জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেন। ওই কোম্পানির দুর্নীতির তদন্ত করতে জেলেনস্কিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন ট্রাম্প। এমন অভিযোগ তোলে জো বাইডেনের দল ডেমোক্রেটিক পার্টি।
আর এভাবেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তখনকার বিরোধী দলের অভিশংসন বিল পাসের চেষ্টার মতো আলোচিত ওই ঘটনার সঙ্গে জুড়েছিল জেলেনস্কির নাম।
রুশ হামলায় প্রশংসিত জেলেনস্কি
রাশিয়ার সামরিক হামলার মুখে পালিয়ে না গিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছেন ইউক্রেনের এই প্রেসিডেন্ট।
অনেকেই তাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ও যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিলের সঙ্গে তুলনা করেন।
উইনস্টোন চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তির হামলার মুখে প্রায় বিপর্যস্ত যুক্তরাজ্যকে জয়ের স্বাদ পেতে মূল পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। তার বিচক্ষণতায় মিত্র বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে যুক্তরাজ্য যুদ্ধে জয় নিশ্চিত করেছিল।
তাই অনেকেই এবার জেলেনস্কিকে তুলনা করছেন যুদ্ধকালে সেই সফল বিশ্বনায়ক চার্চিলের সঙ্গে।