ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া সেনা মোতায়েনের পর কয়েক দিন ধরে চলছিল টানটান উত্তেজনা। অবশেষে এই উত্তেজনা না থেমে বরং আরও বেড়েছে। হামলা হবে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর এসেছে অস্ত্রের মাধ্যমে। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করেছে ভ্লাদিমির পুতিনের বাহিনী।
ঘটছে প্রাণহানি, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সম্পদ। ক্ষতি যে শুধু ইউক্রেনের হচ্ছে তা নয়, হচ্ছে রাশিয়ারও। কিন্তু তারপরও কেন হামলা চালিয়েই যাচ্ছে রাশিয়া? আসলে কী চাইছেন পুতিন?
হামলার নেপথ্য, ইউক্রেন পরিস্থিতি, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন- এসবের বাইরেও এখন আলোচনায় আসছে অনেক কিছুই। সব মিলিয়ে বিশ্ব রাজনীতি কোন পথে, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
চার কোটি ৪০ লাখ মানুষের আবাসস্থল ইউক্রেন একটি উন্নয়নশীল দেশ। পূর্ব ইউরোপের এ দেশের পশ্চিমে পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পশ্চিমে রোমানিয়া ও মলদোভা, দক্ষিণে কৃষ্ণসাগর ও আজভ সাগর, পূর্বে ও উত্তর-পূর্বে রাশিয়া এবং উত্তরে বেলারুশ। কিয়েভ ইউক্রেনের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর ঘোষণা দেন পুতিন। আকাশ-সড়ক-সমুদ্রপথে চলছে যুদ্ধ। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ইউক্রেন সেনারা। সঙ্গে যোগ দিয়েছে বেসামরিক নাগরিকও। রাজধানী কিয়েভসহ কয়েকটি এলাকায় বেশ শক্তিশালী হামলা চালিয়েছে রুশ সেনারা।
রাজধানী ঘিরে রুশ সেনারা থাকায় কার্যত সেখান থেকে বের হওয়ার উপায় নেই কারোরই। কিয়েভের রাজপথ দখল নিয়ে আছে ইউক্রেন সেনারা। তবে অন্য জায়গাগুলোতে কখনও ইউক্রেন কখনও রাশিয়ার হাতে চলে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ইউক্রেনবাসীর জীবন এখন হাতের মুঠোয়।
রাশিয়ার সেনারা কেন আক্রমণ করল
আধুনিক ইউক্রেনের ক্রমাগত হুমকির মুখে রাশিয়া মোটেও নিরাপদ নয় জানিয়ে টেলিভিশন ভাষণে যুদ্ধের ঘোষণা দেন পুতিন। এরপরই শুরু হয় রুশ সেনাদের হামলা। উত্তর,পূর্ব এবং দক্ষিণ থেকে ইউক্রেনের রাজধানীতে আকাশ, সড়ক ও সমুদ্রপথে আক্রমণ শুরু করে তারা। পরে ক্রমেই এগিয়ে যেতে থাকে।
প্রথমে সেনা সদর দপ্তর এবং বিমানবন্দরে হামলায় চালায় রুশ সেনারা। এরপর এগোতে থাকে কিয়েভের মূল কেন্দ্রের দিকে।
যুদ্ধ শুরুর আগে নানা বিষয়ে মিথ্যা যুক্তি ও অসত্য তথ্য দিতে থাকেন পুতিন। তিনি দাবি করেন, তার লক্ষ্য গণহত্যার শিকার লোকদের রক্ষা করা এবং ইউক্রেনকে ‘অসামরিকীকরণ এবং নাৎসীকরণের হাত থেকে বাঁচানো।’
সব অভিযোগই অবশ্য অস্বীকার করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি। গণতান্ত্রিক এই দেশে গণহত্যার কোনো ঘটনা ঘটেনি বলেও জানান তিনি।
কয়েক মাসের আন্দোলনের পর ২০১৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় ইউক্রেনের রুশপন্থি প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে। ভ্লাদিমির পুতিন বিষয়টি নিয়ে বারবারই জেলেনস্কিকে দোষারোপ করে আসছেন। তার অভিযোগ চরমপন্থিরা ভিক্টরকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
ওই ঘটনার পর ক্রিমিয়ার দক্ষিণাঞ্চল দখল করে প্রতিশোধ নেয় রাশিয়া। এ ছাড়া পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহ শুরু করা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেয় তারা। সে সময় ইউক্রেনীয় বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে ১৪ হাজার মানুষের প্রাণ যায়।
পরে আবার ২০২১ সালে ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে রাশিয়া। অবশ্য সে সময় যুদ্ধের কোনো পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করে দেশটি। এরপর পুতিন ২০১৫ সালের একটি শান্তিচুক্তি বাতিল করেন। ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলনের পর দুটি এলাকাকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয় রাশিয়া।
রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোতে ইউক্রেনের অন্তর্ভু্ক্তির বিরোধিতা করে আসছে। ন্যাটোকে তাদের রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছে রাশিয়া।
রাশিয়া কতদূর যাবে?
রাশিয়া যে ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের মতো কাউকে বসাতে চায়, এ ব্যাপারটা পরিষ্কার। তাদের ভাষায় ব্যাপারটা ‘নাৎসিমুক্ত করা’। এসব নিয়ে স্পষ্ট ব্যাখা দিয়ে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, ‘রাশিয়ার প্রথম লক্ষ্য হলো আমি। আর দ্বিতীয় লক্ষ্য আমার পরিবার।’
এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না পুতিন ইউক্রেনে কী করতে চান। তবে একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে দেশটির জনসাধারণকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করাও তাদের লক্ষ্য।
হামলা ইউরোপের জন্য কতটা ক্ষতিকর
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা যেমন দেশটির নাগরিকদের জন্য ভয়াবহ, তেমনই ভয়ংকর পরিণতি অপেক্ষা করছে এর প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতটা ভীতিকর অবস্থা আর কখনও দেখেনি তারা। যুদ্ধে এরই মধ্যে ইউক্রেনের শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে।
জার্মানি একে বলছে ‘পুতিনের যুদ্ধ’। পুতিন ইউক্রেনে ‘রাশিয়ার সরকার’ চায় বলে মনে করে তারা। ইউরোপের অন্য দেশগুলোর জন্যও এই হামলার ঘটনা এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা। ইউক্রেন ইতোমধ্যে রাশিয়া সমর্থিত যোদ্ধাদের সঙ্গে আট বছর ধরে যুদ্ধ করেছে। ইউক্রেনবাসীদের জন্য প্রতিটি মুহূর্তই এখন চরম ভয়াবহ।
পুতিন ইউক্রেনে যে হামলা শুরু করেছেন, এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না রাশিয়ার নাগরিকেরাও। এমনকি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে যথাযথ রীতি ছাড়াই এই যুদ্ধের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতিতে যুদ্ধের আঁচ পড়েছে ইউক্রেন-রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলোর ওপরও। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হুড়োহুড়ি করে সীমান্তে ছুটছে মানুষ। চেষ্টা করছে পাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, মলদোভা, রোমানিয়া ও স্লোভেকিয়াতে ঢোকার চেষ্টা করছেন ইউক্রেনের বাসিন্দারা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, ৭০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে।
হামলা চালাতে এসে পাঁচ হাজারের বেশি রুশ সেনা নিহত হয়েছে বলে দাবি ইউক্রেনের। আর ইউক্রেনের যে শতাধিক মানুষ মারা গেছে, তাদের মধ্যে আছে শিশু-নারীও। এখন পর্যন্ত পঁচ লাখ মানুষ ইউক্রেন যুদ্ধে শরণার্থী হয়েছে বলে জানা গেছে।
পশ্চিমারা কী করছে
ন্যাটো এরই মধ্যে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছে, ইউক্রেনকে সেনা পাঠানোর পরিকল্পনা তাদের নেই। তবে এর সদস্য দেশগুলোর কেউ কেউ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে। কেউ অর্থ কেউ অস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে তারা অস্ত্র ও অর্থ পাঠাবে। সুইডেন অস্ত্র পাঠানোর কথা জানিয়েছে। এ ছাড়া বাল্টিক সাগরে কয়েক হাজার সেনা রেখেছে ন্যাটো।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও কানাডা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে রাশিয়ার ওপর। আকাশসীমা ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। নিষেধাজ্ঞা এসেছে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর। ইউরোপজুড়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম স্পুতনিক ও রাশিয়া টুডে।
পুতিনের দাবি কী
ভ্লাদিমির পুতিন চান ইউক্রেন যেন কখনই ন্যাটোতে যোগ না দেয়। এই জোটটি ঘড়ির কাঁটা ১৯৯৭ সালে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, রাশিয়ার পিছে ফেরার কিছু নেই।
পুতিন চান ন্যাটো তাদের সদস্য দেশগুলো থেকে তাদের বাহিনী এবং সামরিক অবকাঠামো সরিয়ে ফেলুক। একই সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে তারা যেন ভারী যুদ্ধাস্ত্র মোতায়েন না করে তারও নিশ্চয়তা চান তিনি। তবে জার্মানির মতে ‘রাশিয়ার নেতা তার বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ইউরোপ দখল করতে চান।’
গত বছর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন রাশিয়ান এবং ইউক্রেনীয়দের ‘এক জাতি’ হিসাবে বর্ণনা করে একটি দীর্ঘ রচনা লিখেছিলেন। তিনি ওই লেখায় ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ‘ঐতিহাসিক রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতা’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
পুতিনের দাবি, আধুনিক ইউক্রেন সম্পূর্ণরূপে কমিউনিস্ট রাশিয়া দ্বারা তৈরি এবং এখন পশ্চিমা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি পুতুল রাষ্ট্র।
২০১৩ সালে ইইউর সঙ্গে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার জন্য ইউক্রেনের ওপর তার চাপ ছিল। ক্রেমলিনপন্থি প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যাপারটি নিয়েও ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দেয় রাশিয়ায়। এর রেশ চলতে থাকে বহুদিন। অবশেষে তা যুদ্ধে গড়াল।
যুদ্ধ পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কী আর পুতিনইবা কী হিসাব নিয়ে বসে আছেন তা জানতে অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত বিশ্ববাসীর সামনে কোনো পথ নেই। সময়ই নির্ধারণ করে দেবে এই হিসাব-নিকাশ। নতুন করে হয়তো লেখা হবে ইতিহাস।