দেশকে বিদেশি শাসকমুক্ত করার প্রতিশ্রুতিতে গত আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে তালেবান। কিন্তু দেশ শাসনে অদক্ষ তালেবান পাঁচ মাসেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে আছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এ সময়ে চরমে পৌঁছেছে।
আফগানিস্তানের জনসংখ্যা চার কোটির বেশি। এই অবস্থায় দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্যসীমার নিচে চলে এসেছে। তবে এটা পাঁচ বছর ধরে। অর্থাৎ আমেরিকান মদতপুষ্ট ঘানি সরকারের সময়েও এই অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে আফগানিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ।
স্কাই নিউজের খবরে বলা হয়েছে, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক বিষয়গুলো তো দূরের কথা, টিকে থাকার প্রয়োজনীয় খাদ্য জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে জনগণ।
সন্তানদের খাবার জোগাড় করতে নিজেদের কিডনি পর্যন্ত বিক্রি করে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। এমনকি সন্তান পালনে অক্ষম হওয়ায় তাদেরও বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে।
অবশ্য অনেক বছর ধরেই এক টুকরো রুটির জন্য নামমাত্র মূল্যে কিডনি বিক্রি করে আসছে আফগান নাগরিকরা। সম্প্রতি এই প্রবণতা বেড়েছে ব্যাপক।
সবচেয়ে নাজুক অবস্থা হেরাত শহর থেকে ১২ মাইল দূরের শেহের-ই সেবজ অঞ্চলে। পশতুন সম্প্রদায়ের এসব মানুষ তালেবানের সঙ্গে আফগান সরকারের চার বছর ধরে চলা রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের কারণে হারিয়েছে ভিটেমাটি। কুঁড়েঘরে কোনো রকমে টিকে আছে তারা।
৩৮ বছরের স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কাদির ভীষণ অসুস্থ দীর্ঘদিন ধরে। শুধু চা আর এক টুকরো রুটি খেয়ে দিন পার করছেন তিনি। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না।
আবুল কাদির বলেন, ‘একটি কিডনি বিক্রি করতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। দাম চেয়েছি ১ হাজার ডলারের কিছু বেশি। কিন্তু চিকিৎসক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, অস্ত্রোপচারে কিডনি সরিয়ে ফেলা হলে আমি আর বাঁচব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই কথা শুনেও আমি কিডনি বিক্রি করতে রাজি হয়েছি। আমাদের অবস্থা আসলেই খুব খারাপ। আমার মৃত্যুর বদলে যদি পরিবারের লোকজন ভালো থাকে, আমি তাতেই খুশি।’
স্থানীয়রা বলছেন, তাদের জন্য কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। শিশুরা আবর্জনার স্তূপ থেকে প্লাস্টিক, কাগজ কুড়াচ্ছে। পরে সেগুলো বিক্রি করছে। নারীরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুতা এনে কাপড় বুনছেন। এভাবে দিনে এক ডলারের বেশি আয় সম্ভব হয় না।
গুলবুদ্দিন নামে ৩৮ বছরের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘আমি এখন আর কাজ করতে পারি না। একটা কিডনি বিক্রি করে দেয়ার পর থেকে এই অবস্থা।
‘তিন বছর আগে সাড়ে ৩ হাজার ডলারে আমার ১২ বছরের মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছিলাম। দুই বছর আগে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ২ হাজার ডলারে বিক্রি করি একটি কিডনি।’
গুলবুদ্দিন আরও বলেন, ‘গত বছর দেড় হাজার ডলারে আমার ছয় বছরের মেয়েকেও বিক্রি করে দিয়েছি। এখন কেউ যদি আমার চোখ চায়, তবে তাতেও রাজি আছি।’
সন্তান বিক্রি
চার সন্তানের জননী ৩০ বছরের বিবিজানা বলেন, ‘ একটি কিডনি ৪৮৬ ডলারে বিক্রি করেছি। এক মেয়েকেও বেঁচে দিয়েছি। এই টাকা দিয়ে ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনেছি।
‘মনে হচ্ছে আমার জন্ম না হলেই ভালো হতো। এদিন দেখতে হতো না। প্রতিটি মুহূর্তে জাহান্নামের সাজা ভোগ করছি।’
ক্রেতা কারাযারা কিডনি বিক্রি করতে চান, তারা সরাসরি যোগাযোগ করেন হাসপাতালগুলোয়। সেখানে খোঁজ নেন কিডনি লাগবে এমন রোগীর।
রাজধানী কাবুলের সবচেয়ে বড় হাসপাতালের ডায়ালাইসিস সেন্টারের চিকিৎসক হোসাল তুফান বলেন, ‘ গত পাঁচ বছরে দুই শতাধিক মানুষ তাদের কিডনি বিক্রির জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু আমরা তাদের ফিরিয়ে দিই।’
আফগানিস্তানে রমরমা কিডনি বাণিজ্য
কাবুলের পাশাপাশি হেরাত এই কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য পরিচিত। হেরাতে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য দুটি হাসপাতাল আছে। এসব কিডনির মূল ক্রেতা ইরান ও তুর্কমেনিস্তানের নাগরিকরা।
তালেবান শাসনে কিডনি-বাণিজ্য নিষিদ্ধএকটি বেসরকারি হাসপাতালের পরিচালক জানান, গত ছয় বছরে শতাধিক কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন তারা।
তিনি বলেন, ‘ আগে সব নিয়ম মেনে কিডনি প্রতিস্থাপন হতো। কিন্তু তালেবান সরকার গত ১৬ জানুয়ারি, রক্তের সম্পর্ক নেই এমন ব্যক্তিদের কাছে কিডনি নেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিডনি-বাণিজ্য বন্ধে এটা উপযুক্ত সিদ্ধান্ত।’
হেরাত প্রদেশের সাংস্কৃতিক ও তথ্যবিষয়ক পরিচালক এবং তালেবানের প্রাদেশিক মুখপাত্র বলেন, ‘সন্তান এবং অঙ্গ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। শিগগিরই আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আলোর মুখ দেখবে।’