আফগানিস্তানে গত আগস্টে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটিতে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। গত ছয় মাসে দেশটি ছেড়ে পালিয়েছেন অসংখ্য নাগরিক। তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নিপীড়নের অভিযোগও রয়েছে।অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়া অর্থনীতি নিয়ে তালেবান সরকারও উদ্বিগ্ন। নানাভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টা করছে তারা। এমনকি দেশটিতে গাঁজা চাষে বিদেশি বিনিয়োগ পেতেও মরিয়া সরকার।
গত নভেম্বরে তালেবান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক টুইট বার্তায় জানায়, আফগানিস্তানে গাঁজা প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা স্থাপনের জন্য তারা সিফার্ম নামে একটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে ৪০ কোটি ইউরোর চুক্তি করেছে।
খবরটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তোপের মুখে পড়ে অস্ট্রেলিয়ান মেডিক্যাল কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান সিফার্ম। প্রতিষ্ঠানটি দাবি, এ চুক্তির বিষয়ে তারা কিছুই জানে না।
পরে জানা যায়, সিফার্ম ইন্টারন্যাশনাল (ইসিআই) একটি জার্মান গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা। এই প্রতিষ্ঠান গত ২০ বছর ধরে গাঁজা গাছ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে।
৫৬ বছর বয়সী ভের্নার জিমারমান প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সভিত্তিক সাইট ভাইসকে জানান, চুক্তির বিষয়টি প্রকাশ হওয়ায় তিনি বিরক্ত। অনেকেই চুক্তিটিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করছে এবং মিডিয়া পিছু ছাড়ছে না।
জিমারমান জানান, তার প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বিশ্বের অনেকগুলো দেশের সঙ্গে কাজ করেছে। এসব দেশের মধ্যে আছে লেসুটু, মরক্কো, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, নর্থ মেসিডোনিয়া ও সাইপ্রাস।
সিফার্ম ইন্টারন্যাশনাল গাঁজা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপনে পারদর্শী। এছাড়া এক দেশ থেকে আরেক দেশে কীভাবে গাঁজা আইনিভাবে রপ্তানি করা যায় সে বিষয়েও প্রতিষ্ঠানটি পরামর্শ দেয়। কাজাখস্তানে পাঁচ লাখ ইউরোর একটি কারখানা স্থাপন করতে যাচ্ছে সিফার্ম। এর পরই কাজ শুরু হবে আফগানিস্তানে।
কান্দাহারে গাঁজা গাছ পরখ করছেন আফগান চাষী। ছবি: এএফপি
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য আফগানিস্তানে ওষুধি গাঁজা চাষের পরিকল্পনা রয়েছে জিমারমানের। তবে জার্মানির মতো দেশগুলো গাঁজা সেবন বৈধ ঘোষণা করলে তার প্রতিষ্ঠান আফগানিস্তানে সাধারণ গাঁজা চাষও করবে।
আফগানিস্তানে শত শত বছর ধরে গাঁজা গাছ চাষ হচ্ছে। ১৯৭০ এর দশকে দেশটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে গাঁজা সেবন নিষিদ্ধ করা হলেও, তালেবান ক্ষমতার আসার আগ পর্যন্ত দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে গাঁজা সেবনের রীতি ছিল।
জিমারমান বেশ কয়েক বার আফগানিস্তান গেছেন। একজন পেশাদার অ্যাথলিট ও দূরপাল্লার দৌড়বিদ হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা জিমারমান ১৯৮৯ সালে কাজাখস্তানের আলমাটিতে তখনকার সোভিয়েত সৈনিকদের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে তার সঙ্গে বেশ কিছু আফগান নাগরিকেরও দেখা হয়। ১৯৯১ সালে জিমারমান আফগানিস্তান ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।
জিমারমানের দাবি, আফগানিস্তানে তিনি সোভিয়েতবিরোধী গেরিলা নেতা আহমাদ শাহ মাসুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন। সোভিয়েত সেনাদের বিতাড়িত করার পর শাহ মাসুদ সামরিক বাহিনী নর্থ অ্যালায়েন্স গঠন করেন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসা তালেবান সরকারের বিরোধী ছিল এই বাহিনী। ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মাসুদকে হত্যা করা হয়। তার ছেলে আহমাদ মাসুদ বর্তমান তালেবান প্রতিরোধ শক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা।
জিমারমানের দাবি, আফগানিস্তান সম্বন্ধে তার জানাশোনা অনেক বিস্তৃত। তিনি জানান, বর্তমানে পরামর্শ দেয়ার জন্য আফগানিস্তান থেকে কোনো অর্থ পাচ্ছেন না। তার প্রতিষ্ঠান তখনই আয় করা শুরু করবে যখন গাঁজা আইনিভাবে রপ্তানি শুরু হবে।
প্রশ্ন উঠছে জার্মান একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে এমন একটি সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করবে যাকে জার্মানির সরকারই স্বীকৃতি দেয়নি! জিমারমান অবশ্য মনে করছেন, জার্মানির উচিত তালেবানদের স্বীকৃতি দেয়া। যে কারণে মূলত তার ভূমিকা হচ্ছে তালেবানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে সহায়তা দেয়া এবং অদূর ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা।
জিমারমান বলেন, ‘আমরা তো অপরাধী নই!’
গাঁজা ক্ষেতে কাজ করছে আফগান কিশোর। ছবি: এএফপি
তালেবানদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সম্পর্কে জিমারমান বলেন, ‘আমি সেগুলো জানি। তবে আফগানিস্তান একক কিছু নয়। অনেকগুলো গোত্র ও পরিবারের সদস্যরা দেশের ইমেজকে বিদেশে প্রভাবিত করছে। আমি পেশাদার ভাবে কাজ করি। আমার কাজ দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে। আমার প্রজেক্টের মাধ্যমে আমি তাদের সমর্থন করি।’
জার্মান এ ব্যবসায়ী জোর দিয়ে বলেছেন তিনি সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করেন না। আফগানিস্তানে চলমান মানবাধিকার সংকটের বিষয়ে তিনি অনেকটাই নিয়তিবাদী।
জিমারমান বলেন, ‘আফগানিস্তানের চলমান নৈতিকতা ও আদর্শের সঙ্গে আমি যেভাবে মানবতাকে দেখি তার কোনো মিল নেই। তবে আমি একে বদলাতে পারব না। আমি আফগান সরকারকে সমর্থন করি বলে বলছি না, তবে আমার মনে হয় জীবনে আফগানিস্তানে সমতা ফিরবে না।’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে একাধিক দেশ ইতোমধ্যে তালেবান সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে এ নিষেধাজ্ঞা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র আফগানের ওপর প্রভাব ফেলেছে এবং চলমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরও তীব্র করেছে। দেশটিতে এখন ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছেন।
আপাতত, সিফার্ম ও তালেবানের মধ্যে চুক্তি স্থগিত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে৷ সিফার্ম বলছে, বিনিয়োগ করার আগে তারা নতুন তালেবান সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়।
জিমারমান জানান, তিনি আপাতত এ চুক্তি স্থগিতের কথা ভাবছেন। কারণ তিনি ইউরোপিয়ান ড্রাগ কার্টেলগুলোর কাছ থেকে মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন। আফগানিস্তানে জিমারমানের গাঁজার ব্যবসা তাদের অবৈধ মাদক ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াতে পারে।
একই ধরনের সতর্ক বার্তা জিমারমান পেয়েছেন কিরগিজস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে। কিরগিজস্তানের মন্ত্রী তার বন্ধু। দেশটিতে জিমারমানের একটি বাড়িও রয়েছে। তিনি স্বীকার করেন, আফগানিস্তানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা অনুমান করা কঠিন। তবে, জিমারমানের দাবি তার মনের শক্তি অনেক বেশি।