ভারতের উত্তর প্রদেশে গত নভেম্বরের এক সকালে বাড়িতে বসে আয়েশ করে চা পান করছিলেন রাম রাজ। আচমকা বেওয়ারিশ এক গরু তাকে আক্রমণ করে বসে।
বিষয়টির এখানেই শেষ হয়নি। এর পরপর আক্রমণের শিকার হয় তার নাতি। এ ঘটনায় ৫৫ বছরের কৃষক রাম প্রাণ হারান। হাসপাতাল পর্যন্ত নেয়া যায়নি তাকে।
রামের পুত্রবধূ আনিতা কুমারী বলেন, ‘আমাদের জীবনের ভয়াবহ ঘটনা ছিল এটি। শোকে থেকে আমার শাশুড়ির খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।’
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ভারতের জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশে এমন ঘটনা সম্প্রতি বেড়েছে। রাজ্যটিতে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করার পর বেওয়ারিশ গরুর সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। আর এটি যোগী আদিত্যনাথ সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হিন্দু মতে, গরু পবিত্র, পূজনীয়। তারপরও অনেক কৃষক তাদের বুড়ো হয়ে যাওয়া গরুগুলোকে কসাইখানায় বিক্রি করে দেয়।
হিন্দু মতে গরু পবিত্র প্রাণী। ছবি: বিবিসি
কৃষক শিব পুজান বলেন, ‘গরু যখন দুধ দেয়া বন্ধ করে দেয় অথবা বৃদ্ধ হয়ে যায় (চাষাবাদের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে) তখন আমরা তা বিক্রি করে দিই।’
কিন্তু কেন্দ্রে আসীন ক্ষমতাসীন দল বিজেপি গো-হত্যার চরম বিরোধী। উত্তর প্রদেশসহ ১৮ রাজ্যে গো-হত্যা অবৈধ ঘোষণা করেছে মোদি সরকার।
কট্টর মতাদর্শের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ২০১৭ সালে ক্ষমতায় এসেই কসাইখানা বন্ধ করে দেন; যদিও এটি রাজ্যের অন্যতম বড় খাত।
গরু ব্যবসায়ীরা বেশির ভাগ মুসলিম, আছে কিছু দলিত সম্প্রদায়ের লোক। রাজ্য সরকারের আদেশ অমান্যে তাদের অনেকের ওপর হামলা হয়েছে। খুন হয়েছেন অনেকেই। স্থানীয় বিজেপি নেতা-কর্মীরা অনেকটা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই এসব নিপীড়ন চালিয়েছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। খাবারের জোগান দিতে না পারায় বাধ্য হয়ে বুড়ো গরুগুলোকে পাশের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসে তারা।
কৃষক পুজান বলেন, ‘এখানে গরুর কোনো ক্রেতা নেই। আমাদের বাধ্য করা হয়েছে বুড়ো গরুগুলোকে জঙ্গলে পাঠিয়ে দিতে।’
জঙ্গলে খাবার না পেয়ে এসব গরু ঢুকে পড়ে শহর কিংবা গ্রামের লোকালয়ে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর গরুগুলো তখন হয়ে ওঠে বেপরোয়া।
পুজান বলেন, ‘এমন কোনো একটি গরু সেদিন রাম রাজের বাড়িতে খাবারের সন্ধানে ঢুকে পড়েছিল। তার পরিবার গরুটিকে দেখে চিৎকার চেঁচামেচি করলে আক্রমণ করে বসে গরুটি।
ক্ষেতের ফসল বাঁচাতে সম্প্রতি এমন দুটি গরুর আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন পুজান নিজেও।
তিনি বলেন, ‘গরু দুটি আমাকে গুঁতো দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছিল। কোনোরকমে দৌড়ে জীবন বাঁচাই। তারকাঁটার বেড়ায় হাত কেটে যায়। এখন ব্যান্ডেজ নিয়ে ঘুরছি।’
পুজান নিজেও ধর্মভীরু। কিন্তু তাতেও সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছেন না তিনি। তার দাবি, বেওয়ারিশ এসব গরু ফসল নষ্ট করছে, সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা মানুষ হত্যা করছে।
কৃষক পুজান গরুকে পবিত্র মানলেও বেওয়ারিশ গরুকে মানুষের জন্য হুমকি বলছেন। ছবি: বিবিসি
এসব বেওয়াশির গরুর কারণে জীবন পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেছে পুনম বোল নামের এক বিধবার। গরুর আক্রমণে প্রাণ গেছে তার স্বামীর, সন্তান হয়ে গেছে শারীরিক প্রতিবন্ধী।
করোনার কারণে ২০২০ সালে চাকরি খুইয়েছিলেন ৩৬ বছরের যুবক ভূপেন্দ্র দুবে। গ্রামে ফেরার কিছুদিনের মাথায় গরুর আক্রমণে প্রাণ হারান তিনি। স্থানীয় বাজারে ছেলের জন্য মিষ্টি কিনতে গিয়েছিলেন ভূপেন্দ্র। সেখানেই বেওয়ারিশ এক গরু আক্রমণ করেছিল তাকে।
চার বছরের বেশি সময়ে এমন ঘটনার নজির অনেক। ২০১৯ সালে রাম খালি নামে ৮০ বছরের এক ব্যক্তি গরুর আক্রমণের শিকার হয়ে কোমায় চলে যান।
আগামী ২২ মার্চ উত্তর প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। রাজ্যের বেশির ভাগ বাসিন্দা কৃষক। ভোটার টানতে তাই এই ইস্যুটিকে সামনে তুলে আনছে বিরোধীরা।
বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি। তাদের শীর্ষ নেতারা বলছেন, এই সংকট সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখপাত্র সমির সিং বলেন, ‘হিন্দু রীতিতে বৃদ্ধ গরুকে জঙ্গলে পাঠানোর কোনো নিয়ম নেই। আমরা কখনও পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে এমন করি না। তবে গরুকে কীভাবে মরার জন্য রাস্তায় ছেড়ে আসা হয়?
‘এসব গরুর জন্য লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এমন হাজার হাজার আশ্রয়কেন্দ্রের খরচ জোগাতে মদের ওপর কর বাড়ানো হয়েছে।’
কিন্তু এই উদ্যোগ যে কার্যকরী না তার প্রমাণ পেয়েছে বিবিসি। অযোধ্যায় সরকার পরিচালিত একটি গরু আশ্রয়কেন্দ্র বিবিসি হিন্দির শত্রুঘ্ন তিওয়ারি সরেজমিনে ঘুরে দেখতে পান, কানায় কানায় ঠাসা প্রতিটি কেন্দ্র।
তিনি বলেন, ‘এখানে ২০০ গরু আছে। এটাই সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা। আরও ৭০০ থেকে ১০০০ গরু আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
ফসল বাঁচাতে কেন্দ্রে আশ্রয় না পাওয়া এসব বেওয়ারিশ গরু নজরে রাখছে স্থানীয় কৃষকরা। ঠাণ্ডা আর সাপের ছোবল উপেক্ষা করে পালাক্রমে ২৪ ঘণ্টা পাহারা দিয়ে যাচ্ছে তারা।
রাত জেগে ফসল পাহারা দিচ্ছেন এক নারী কৃষক। ছবি: বিবিসি
৬৪ বছরের কৃষক বিমলা কুমারী বলেন, ‘সকালে একদল এসে পাহারা দেয়, রাতে অন্য দল। এই বিষয়টা নিয়ে আমরা চরম বিরক্ত। ভাবছি নির্বাচন বয়কট করব।’
দিনা নাথ নামে আরেকজন বলেন, ‘কেন এমন নির্বাচনে ভোট দেব, যেখানে নির্বাচিতরা সাধারণের কষ্ট বুঝবে না।’