বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শত শত ইহুদির খুনিকে পাওয়া গেল যেভাবে

  • রুম্পা রায়   
  • ৮ জানুয়ারি, ২০২২ ২০:২৩

সাওনিউক ছিলেন জার্মান নাৎসি বাহিনীর সহকারী, যিনি একের পর এক ইহুদিদের ধরে নিয়ে গেছেন। পুরুষ, নারী, এমনকি শিশুদেরও ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যার পর লাশ ফেলে দিয়েছেন গণকবরে।

লন্ডন ব্রিজে বছরের পর বছর হাজারও যাত্রী তার কাছ থেকে টিকিট সংগ্রহ করেছেন। তবে তাকে ভালোভাবে দেখার সুযোগ তেমন ঘটেনি। টনি সাওনিউক নামের এই টিকিট কালেক্টর কারও সঙ্গেই খুব একটা কথা বলতেন না। যাত্রীদের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে মুখ ঢেকে রাখতেন লম্বা টুপিতে।

এই অদ্ভুত আচরণের কারণটা আর কিছু নয়, তার নৃশংস অতীত। পরে বেরিয়ে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনিই হাসিমুখে হত্যা করেছেন প্রতিবেশী শত শত ইহুদিকে।

দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করেও ব্রিটিশ রেলওয়ের সহকর্মীরা বুঝতে পারেননি এই মানুষটি ভয়াবহ কোনো ঘটনা আড়াল করে রেখেছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নেতৃত্বে জার্মান নাৎসি বাহিনী ইউরোপে ইহুদিদের নির্বিচারে হত্যা করে। প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি এবং আরও অনেক সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা করে তারা।

ডেইলি মেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাওনিউক ছিলেন নাৎসিদের এমন একজন সহযোগী, যিনি একের পর এক ইহুদিদের ধরে নিয়ে গেছেন। পুরুষ, নারী, এমনকি শিশুদেরও ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যার পর লাশগুলো ফেলে দিয়েছেন গণকবরে।

তার এই অপরাধ আড়ালেই থেকে যেত। তবে মাইক অ্যান্ডারসন এবং নিল হ্যানসনের লেখা একটি বইয়ের মাধ্যমে তার খোঁজ মেলে। শেষ পর্যন্ত তাকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মুখোমুখি করা হয়।

সাওনিউকের জন্ম ১৯২১ সালে বেলারুশের ডোমাচেভো শহরে। এটি এখন বেলারুশের শহর, তবে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিল পোল্যান্ডের অংশ। শহরটির বেশির ভাগ বাসিন্দা ছিলেন ইহুদি। সাওনিউক খ্রিষ্টান ছিলেন। তার মা ছিলেন অবিবাহিত।

সাওনিউক একজন ‘জারজ’ হিসেবে কটূক্তি শুনে শুনে বড় হন। ছোট থেকেই তার বিরুদ্ধে চুরিসহ নানা অভিযোগ আসা শুরু হয়। ১৪ বছর বয়সে মা মারা গেলে তিনি একা হয়ে পড়েন।

এর মধ্যেই ইউরোপে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। ১৯৪১ সালের মাঝামাঝি অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি বাহিনী তার শহরে তাণ্ডব শুরু করে। এই বাহিনীতে স্থানীয়দেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ডোমাচেভোয় সাওনিউকই হিটলারের বাহিনীতে প্রথম নাম লেখান।

মাইক অ্যান্ডারসন এবং নিল হ্যানসনের বইতে লেখা হয়েছে, 'শহরের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের মধ্যে সাওনিউকের অবস্থান ছিল নিম্ন। কিন্তু পুলিশের নীল ইউনিফর্ম পরার পর জীবনে প্রথম তিনি নিজেকে কর্তৃত্ববাদীদের একজন ভাবতে শুরু করেন। শহরের লোকদের তিনি ইচ্ছা করলেই তখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। আগে এ শহরের বাসিন্দারাই তাকে ঠাট্টা করেছিল।’

হিটলারের বাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি সব রকমের নিষ্ঠুরতাকে ছাড়িয়ে যান।

সাওনিউকের মামলার এক সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘১৫ জন নারীকে সাওনিউক এক লাইনে দাঁড় করিয়েছিলেন। তাদের নগ্ন হতে বাধ্য করেছিলেন। তারপর তাদের গুলি করে হত্যা করেন। তাদের মরদেহ লাথি মেরে গর্তে ফেলে দিয়েছিলেন।’

একজন স্থানীয় বলেন, ‘সে ছিল পশু। সাওনিউক একটি এতিমখানার ৫৪ শিশুকে হত্যা করেছিল।’

এরপর যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ১৯৪৪ সালে সাওনিউক নিজের শহর ছেড়ে পালিয়ে যান।

টনি সাওনিউক

যুদ্ধ শেষে দেখা যায়, শহরটিতে মাত্র ১৩ জন ইহুদি জীবিত আছেন। ডোমাচেভোর বাকি চার হাজার ইহুদির শেষ ঠিকানা তখন গণকবর। এদের মধ্যে শত শত ছিলেন সাওনিউকের শিকার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীদের খোঁজে তদন্তকারীরা শহরে যান, তবে তারা সাওনিউককে খুঁজে পাননি।

সাওনিউক কৌশলে পোলিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এরপর তিনি দক্ষিণ লন্ডনের একটি হাসপাতালের চাকরি নেন।

১৯৫৮ সালে সাওনিউক ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পান। সে বছরই আনাস্তাসিয়া নামে আইরিশ নারীকে বিয়ে করেন। এর আগেও তিনি তিনবার বিয়ে করেছিলেন। তার একটি ছেলেও হয়। পরে সেই স্ত্রীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

তিনি ব্রিটিশ রেলে যোগ দেন, প্রথমে পোর্টার হিসেবে, তারপর ক্লিনার হিসেবে। অবশেষে টিকিট সংগ্রাহকের চাকরি। ২৫ বছর চাকরির পর ১৯৮৬ সালে অবসর নেন।

ডোমাচেভোকে মুক্ত করার পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধাপরাধ তদন্তকারীরা সাওনিউককে খুঁজছিলেন। তবে তিনি রীতিমতো হাওয়া হয়ে যান।

ব্রিটেনের পার্লামেন্ট ১৯৯১ সালের যুদ্ধাপরাধ আইন পাস করে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে স্থাপন করা একটি বিশেষ ৯ সদস্যের ইউনিটের কাছে রুশ কর্তৃপক্ষের হস্তান্তর করা ৯৭ সন্দেহভাজনের তালিকায় তার নাম ছিল।

তার বিরুদ্ধে 'নিরীহ বেসামরিকদের হত্যায় নাৎসি ফ্যাসিস্টদের সহায়তা করার' অভিযোগ আনা হয়। বেলারুশে তার ভাই ও বোনকে পাঠানো চিঠির সূত্র ধরে অবশেষে ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে তার দরজায় পুলিশ কড়া নাড়ে।

১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিচার শুরু হয়। ডোমাচেভো থেকে ওল্ড বেইলিতে অনেকেই এসেছিলেন তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে।

ইহুদি হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে সাওনিউক বলেন, ‘কেউ আমার দিকে আঙুল তুলে বলতে পারবে না যে আমি একজন ইহুদিকেও হত্যা করেছি।’

জুরিরা সাওনিউককে হত্যার দুটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেন। তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। এর ছয় বছর পর ৮৪ বছর বয়সে কারাগারেই তার মৃত্যু হয়।

এ বিভাগের আরো খবর