লোকমুখে প্রায়ই শোনা যায়, তাজমহল নির্মাণের পর এর নির্মাণশ্রমিকদের হাত কেটে দিয়েছিলেন মোগল বাদশাহ শাহজাহান। আর এটা তিনি করেছিলেন যেন তারা এমন সুন্দর স্থাপত্য আর দ্বিতীয়টি তৈরি করতে না পারেন।
প্রচলিত এই কথাটি সম্প্রতি আবারও আলোচনায় এলো যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশী বিশ্বনাথ মন্দির উদ্বোধন করতে গেলেন।
গত ১৩ ডিসেম্বর সেই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মন্দিরটির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে সম্মান জানান মোদি।
কিন্তু সেখানেই ঘটে বিপত্তি। কারণ এই অনুষ্ঠানটি কাভার করতে গিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ এইটটিনের উপস্থাপক আমিশ দেবগন উচ্চারণ করে বসলেন, ইতিহাসের সেই বহুল প্রচলিত ধারণাটি।
তুলনা টেনে আমিশ বলেন, ‘মন্দিরের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ওপর ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিয়েছেন মোদি, আর তাজমহল নির্মাতাদের হাত কেটে দিয়েছিলেন শাহজাহান।’
শুধু তাই নয়, ভারতের গুজরাটেও একই বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন দেশটির কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তমারও। একটি সভায় গুজরাটি ভাষায় তিনি বলেন, ‘তাজমহলের কর্মীদের হাত কেটে ফেলা হয়েছিল। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোদি কাশী বিশ্বনাথ ধামের উন্নয়নে যারা কাজ করছেন তাদের ওপর ফুল ছিটিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।’
টুইটারে একই বক্তব্য পোস্ট করেছেন বিজেপি নেতা বিনয় টেন্ডুলকারও।
কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ওপর ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছেন মোদি
ঘটনার এ পর্যায়ে এসে বিষয়টি নিয়ে সত্য অনুসন্ধান শুরু করে ফ্যাক্ট চেক সংস্থা অল্টারনেটিভ নিউজ।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যমও একই ধরনের বক্তব্য প্রকাশ করেছিল। সবচেয়ে বড় ব্যপার হলো- ওই ঘটনার ছয় বছর আগে যুক্তরাজ্যেরই শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানও তাজমহল শ্রমিকদের হাত কেটে নেয়ার তথ্য তুলে ধরেছিল।
এবার ইতিহাসবিদ এস ইরফান হাবিবের শরণাপন্ন হয় অল্টারনেটিভ নিউজ। ইরাফান হাবিব বলেন, ‘আমি বলতে পারি যে, এই গল্পটির যথার্থ কোনো প্রমাণ নেই। কোনো বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাসবিদ কখনও এই দাবি নিয়ে হাজির হননি।’
তিনি দাবি করেন, প্রাচীন এই কাহিনিটি ১৯৬০-এর দশকেই ডালপালা মেলে। আর এটি মূলত মানুষের মুখে মুখেই শোনা যেত।
ইরফান হাবিবের মতে, ঘটনাটি শুরুর দিকে শাহজাহানের প্রতি বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও কালক্রমে এটি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
এদিকে ১৯৭১ সালে রাচি ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রকাশিত ইতিহাস বিষয়ক একটি জার্নালে হাত কেটে নেয়ার ঘটনাটিকে একটি শহুরে কানকথা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
২০১৭ সালে ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া তাজমহলের সঙ্গে সম্পর্কিত কতগুলো প্রচলিত কথা খণ্ডন করেছিল। এর মধ্যে একটি খণ্ডনে ওই হাত কাটার প্রসঙ্গটিও ছিল।
এ বিষয়ে সেই প্রতিবেদনে জানানো হয়, হাত কেটে নেয়ার গল্পটির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া তাজগঞ্জ নামে একটি লোকবসতির অস্তিত্ব এখনও বিদ্যমান। সারা দেশ থেকে বাছাই করে আনা কয়েক হাজার নির্মাণশ্রমিক, নকশাকার এবং স্থাপত্য সম্পর্কিত কর্মীদের জন্য ওই তাজগঞ্জের গোড়াপত্তন করেছিলেন মোগল বাদশা শাহজাহান। সেই সব মানুষের বংশধররা এখনও তাজগঞ্জে বসবাস করছেন। পুর্বপুরুষের বিদ্যা ও স্থাপত্যকৌশল তারা এখনও বংশ পরম্পরায় প্রয়োগ করছেন।
২০১৬ সালে ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেও হাত কেটে নেয়ার গল্পটিকে একটি কানকথা হিসেবে উল্লেখ করেছিল।
একই বছরে পাকিস্তানের ডন পত্রিকায়ও এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কারণ নিউ ইয়র্কের নাট্যকার রাজিব জোসেফ তার ‘গার্ড অ্যাট দ্য তাজমহল’ নামে একটি নাটকে ওই প্রচলিত হাত কেটে নেয়ার ঘটনাটিকেই ফুটিয়ে তুলেছিলেন। ডনের প্রতিবেদনে, ৪০ হাজার হাত কেটে নেয়ার সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই বলেই দাবি করা হয়।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো- তাজমহলের ওয়েবসাইটেও এখন পর্যন্ত হাত কেটে নেয়া সম্পর্কিত কোনো তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি। উপরন্তু ওই ওয়েবসাইটে এ সম্পর্কে একটি ব্লগ প্রকাশিত হয়েছে। হাত কেটে নেয়ার গল্পটি কীভাবে লোকমুখে এসেছে, তা নিয়েই মূলত একটি মতামত ছিল ওই লেখায়।
ওই ব্লগে দাবি করা হয়, শাহজাহান হয়তো তাজমহলের কর্মীদের ওপর একটি নৈতিক দায় চাপিয়ে দিয়েছিলেন। হয়তো তিনি শ্রমিকদের সঙ্গে কোনো চুক্তি করেছিলেন, তারা যেন অন্য কোনো সম্রাটের অধীনে কোনো নির্মাণকাজে অংশ না নেয়। আজকের দিনে এই ব্যাপারটিই ‘হাত কেটে দেয়া’র মতো এক উপকথায় পরিণত হয়েছে।