গত এক মাসে তিনটি বড় চালান আটকের মধ্য দিয়ে সৌদি আরবে মাদক সমস্যার আসল চিত্রটি ফুটে উঠেছে।
এর মধ্যে প্রথম চালানে সিরিয়ান সরকারের বিরল সহযোগিতায় ক্যাপটাগন নামে ৫০০ কেজিরও বেশি অ্যামফেটামাইনের একটি চালান বাজেয়াপ্ত করা হয়। একটি পাস্তার চালানে লুকিয়ে এই মাদক সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের উদ্দেশ্যে পাঠানো হচ্ছিল।
পরে আমদানি করা এলাচের একটি চালান থেকে উদ্ধার করা হয় আরও তিন কোটি নেশার ট্যাবলেট। সবশেষ ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে জর্ডান থেকে সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে পাচারের সময় ক্যাপটাগন মাদকের ৪০ লাখ পিল আটক করেছে লেবাননের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী। এই পিল একটি কফির চালানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
ক্যাপটাগনের মতো ভয়ঙ্কর মাদক উদ্ধারের ঘটনা সৌদি আরবে এখন একটি নিয়মিত ঘটনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পিল আকারে অনেক ছোট এবং তৈরি করাও সহজ। সৌদি আরবে এই পিলের বিপুল চাহিদা থাকায় সিরিয়া ও লেবাননে এগুলো তৈরি করা হচ্ছে।
ফরেন পলিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদক পাচারকারীদের কাছে সৌদি আরব এখন অনেক বড় একটি বাজার। বর্তমানে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে মাদকের রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
আরবের সবচেয়ে ধনী এই রাষ্ট্রটিতে ক্যাপটাগন পিল এখন এক নতুন উন্মাদনা। মন ফুরফুরে করার জন্য মাদকসেবীরা এটি গ্রহণ করেন। মূলত এটি আমাদের দেশের বহুল পরিচিত ইয়াবারই আরেকটি রূপ। এই পিল গ্রহণ করলে সহজে ঘুম আসে না এবং মানুষের মাঝে উন্মাদনারও সৃষ্টি করে। সবশেষে এটি স্বাস্থ্যেরও বড় ক্ষতি করে।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে যত ক্যাপটাগন পিল উদ্ধার হয়েছে তার অর্ধেকেরও বেশি হয়েছে সৌদি আরব থেকে।
সিরিয়ার সংকট শুরু হলে মধ্যপ্রাচ্যে ক্যাপটাগন খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মূলত বিভিন্ন পক্ষে যুদ্ধরত সৈন্যরাই এই পিল গ্রহণ করতে শুরু করেন, যেন দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ করা যায়।
পরে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সরকার ও তার পক্ষের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর জাতিসংঘ বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও ক্যাপটাগন মাদকের ব্যবসা তার নিজস্ব ছায়া অর্থনীতি তৈরি করে নিয়েছে।
অভিযোগ আছে, এই মাদক পাচারের সঙ্গে সিরিয়ার সরকারের গভীর সংযোগ রয়েছে। মোটা অঙ্কের অর্থ পেয়ে থাকে বলেই সিরিয়ার সরকার এই ব্যবসা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে।
সিরিয়া ছাড়াও লেবাননের যেসব অঞ্চল ইরানপন্থি হিজবুল্লাহ গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণে, সেসব এলাকায়ই ক্যাপটাগন পিল ব্যাপক পরিসরে উৎপাদন করা হয়।
গত বছর সিরিয়ায় উৎপন্ন হওয়া যত ক্যাপটাগন পিল উদ্ধার করা হয়েছে, তার মূল্য অন্তত ৩ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালেও সিরিয়া ও লেবানন থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের পিল পাচার করা হয়েছে।
চিত্তবিনোদনের যথেষ্ট ক্ষেত্র না থাকা সৌদি আরবে ক্যাপটাগনের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে এই মাদকের ব্যবহার বাড়লেও দেশটিতে তা কোনোভাবেই গাঁজা ও খাট মাদকের চাহিদা কমাতে পারেনি।
সৌদি আরবে গাঁজা প্রবেশ করার বেশ কয়েকটি পথ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত পথটি হলো আফগানিস্তান থেকে প্রথমে ইরানে প্রবেশ করে বিপুল পরিমাণ গাঁজা। পরে এই গাঁজা ইরাক হয়ে সৌদি আরবে প্রবেশ করে। এ ছাড়া লেবানন, সিরিয়া ও জর্ডান হয়েও গাঁজা প্রবেশ করানো হয় দেশটিতে।
অতি সাম্প্রতিককালে ইয়েমেন হয়েও সৌদি আরবে গাঁজা প্রবেশ করছে। আর খাট নামের মাদকের প্রায় সব চালানই ইয়েমেন থেকে সৌদি আরবে প্রবেশ করে। চতুর্দশ শতকে এই মাদকটি সুফি-সাধকরা গ্রহণ করতেন বলে ইয়েমেনে এর একটি সামাজিক স্বীকৃতিও রয়েছে।
সৌদি সরকার আশঙ্কা করছে, এসব মাদক থেকে সুবিধা পাচ্ছে এই রাজতন্ত্রের বিরোধী সামারিক শক্তি ও সংগঠনগুলো। বলা হচ্ছে, দেশটিতে সব ধরনের মাদক পাচারের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গেরিলারা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সৌদি আরবে ১২ থেকে ২২ বছর বয়সীদের মধ্যে মাদকের ব্যবহার বাড়ছে। আর দেশটিতে যারা মাদক সেবন করেন, তাদের ৪০ শতাংশই ক্যাপটাগন পিল গ্রহণ করেন।
মাদকের চালান ঠেকাতে সৌদি আরব এখন কূটনৈতিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া লেবানন থেকে কৃষিপণ্য আমদানি বন্ধ করা ছাড়াও সিরিয়ার আসাদ সরকারকেও নিয়মিত হুমকিধমকি দিচ্ছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন সৌদি আরবেই, যেখানে এখন বিপুলসংখ্যক মাদকসেবী অবস্থান করছে।