সাউথ আফ্রিকা থেকে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে পৌঁছানো দুটি ফ্লাইটের ১৩ যাত্রীর দেহে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ শনাক্ত হয়েছে। এ ছাড়া করোনার অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ধরা পড়েছে আরও ৪৮ জনের দেহে।
আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানায় ১১ নভেম্বর প্রথম করোনার ‘বি.১.১.৫২৯’ ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়, যাকে এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ওমিক্রন’ বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। করোনার নতুন এই ধরনটি এরই মধ্যে সাউথ আফ্রিকাতেও শনাক্ত হয়েছে। দেশটির জোহানেসবার্গ ও প্রিটোরিয়াতে এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার।
এমন প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ সদস্য দেশ শুক্রবার সাউথ আফ্রিকাসহ আফ্রিকার দক্ষিণের সাতটি দেশ থেকে ইউরোপে সাময়িক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়। তবে ওই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার আগেই শুক্রবার সাউথ আফ্রিকা থেকে দুটি ফ্লাইট পৌঁছায় আমস্টারডামে।
বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, এই দুটি ফ্লাইটের প্রায় ৬০০ যাত্রীকে করোনা পরীক্ষার জন্য বিমানবন্দরেই রেখেছিল ডাচ সরকার। এরপর কোভিড শনাক্ত হওয়া যাত্রীদের বিমানবন্দরের কাছেই একটি হোটেলে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে।
ডাচ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যাদের দেহে ভাইরাসটির উপস্থিতি পাওয়া যায়নি তারা নিজেদের বাড়িতে পাঁচ দিনের আইসোলেশনে থাকবেন। এরপর আবার তাদের করোনা পরীক্ষা হবে।
এর আগে মিশর থেকে বেলজিয়াম ভ্রমণে যাওয়া একজনের দেহেও ওমিক্রন শনাক্ত হয়। ইউরোপে বেলজিয়ামই প্রথম দেশ, যেখানে ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, ইসরায়েল ও হংকংয়েও শনাক্ত হয়েছে ভাইরাসটি।
১৩ জনের দেহে ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর ডাচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিউগো দে জং সাম্প্রতিক সময়ে সাউথ আফ্রিকা থেকে নেদারল্যান্ডসে আসা সবাইকে যত দ্রুত সম্ভব করোনা পরীক্ষা করাতে ‘জরুরি অনুরোধ’ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এখন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে নেদারল্যান্ডসে ওমিক্রন সংক্রমিত আরও অনেকে আছেন।’
সার্স কভ টু ভাইরাসের নতুন ধরনটি নিয়ে গবেষকদের উদ্বেগের মূল কারণ, এর অনেকবারের মিউটেশন। মিউটেশন হলো এমন এক অভিযোজন কৌশল যার মাধ্যমে ভাইরাস বিরূপ বা নতুন পরিস্থিতিতেও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে।
বিজ্ঞানীরা ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনে ৩২টি মিউটেশন খুঁজে পেয়েছেন। অন্যদিকে অত্যন্ত সংক্রামক হিসেবে বিবেচিত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে মিউটেশন হয়েছে মাত্র আটবার।
স্পাইক প্রোটিনের বেশি মিউটেশন মানেই ভাইরাসটি বেশি প্রাণঘাতী, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বহুবার মিউটেশনের কারণে ওমিক্রনের সঙ্গে মানুষের দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থার (ইমিউনিটি সিস্টেম) লড়াই করা কঠিন হতে পারে।
ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিন প্রচলিত করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের তুলনায় অনেকটা বদলে যাওয়ায় দেহের ইমিউনিটি সিস্টেম দ্রুত একে শনাক্ত করতে পারে না, ফলে এটি সংক্রমণের হার বাড়াতে পারে। যেকোনো করোনাভাইরাস এদের স্পাইকের সাহায্যেই শ্বাসতন্ত্রের কোষে যুক্ত হয়ে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে।
প্রাথমিক গবেষণা অনুসারে, নতুন ভ্যারিয়েন্টটি টিকার কার্যক্ষমতা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে সক্ষম।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টের দুটি মিউটেশন- আর ২০৩কে এবং জি ২০৪আর ভাইরাসটির দ্রুত প্রতিলিপি তৈরি করতে সক্ষম। এ ছাড়া তিনটি মিউটেশন- এইচ৬৫৫ওয়াই, এন ৬৭৯কে এবং পি ৬৮১এইচ ভাইরাসটিকে আরও সহজে মানব কোষে প্রবেশে সাহায্য করে। তারা বলছেন, শেষ দুটি মিউটেশনের একসঙ্গে উপস্থিতি বিরল ঘটনা এবং এর ফলে ওমিক্রন টিকা প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে।
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার ইনস্টিটিউট অফ মলিকুলার বায়োটেকনোলজির আণবিক জীববিজ্ঞানী ডা. উলরিচ এলিংয়ের মতে, প্রাথমিক লক্ষণ থেকে মনে হচ্ছে করোনার নতুন রূপটি ডেল্টার চেয়ে ৫০০ শতাংশ বেশি সংক্রামক হতে পারে।
অবশ্য নতুন ভ্যারিয়েন্টটি সার্স কভ টুর আগের ধরনগুলোর তুলনায় বেশি প্রাণঘাতী- এমন কোনো প্রমাণ এখনও মেলেনি। তবে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতার কারণে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নতুন করে চাপে ফেলতে পারে।