ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন। এই ধরনটি এবার শনাক্তের খবর দিয়েছে ইউরোপের তিন প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ইতালি। ওমিক্রন ঠেকাতে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলোর ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে অনেক দেশ।
দুই বছরের করোনা মহামারির কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতির চাকা যখন আবার সচল হচ্ছিল তখন নতুন ধরনের খবরে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর আরোপ করা হচ্ছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। উড়তে থাকা পুঁজিবাজার ও জ্বালানি তেলের দামে পড়ছে ভাটার টান।
ওমিক্রন থেকে নিরাপদে থাকতে ভ্রমণ নিধেষাজ্ঞা আরও আঁটসাঁট করতে যাচ্ছে ইসরায়েল। দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ১৪ দিনের নতুন বিধিনিষেধ অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। তাতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলে কোনো বিদেশিকে ঢুকতে দেয়া হবে না।
কোভিডের জন্য দায়ী করোনাভাইরাস সার্স কভ টু-এর নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ নিয়ে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে দেশে দেশে। সতর্ক অবস্থানে আছে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানও।
বতসোয়ানায় প্রথম শনাক্ত হওয়া এই ভ্যারিয়েন্টের শুরুতে নাম ছিল ‘বি.১.১.৫২৯’ তবে আলোচনায় সুবিধার জন্য শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর নাম দেয় ‘ওমিক্রন’।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্পাইক প্রোটিনে ৩০ বারের বেশি মিউটেশনের মধ্য দিয়ে সার্স কভ টু ভাইরাসের নতুন ধরনটি তৈরি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে এই ধরনটির মিউটেশন হয়েছে ৫০ বারের বেশি।
অত্যন্ত সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও ওমিক্রনের মিউটেশন হয়েছে চার গুণ বেশি। ফলে এটি দ্রুত মানুষকে আক্রান্ত করতে সক্ষম বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
এমন অবস্থায় ওমিক্রন রোধে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলোর ওপর আগেভাগেই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ঘোষণা দেয় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এই নিষেধাজ্ঞা সোমবার থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। এর আগেই ইউরোপের কয়েকটি দেশে ঢুকে গেল ওমিক্রন।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ স্থানীয় সময় শনিবার জানান, তাদের দেশে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনে সংক্রমিত হয়েছেন এমন দুজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে।
এমন খবরে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। যারা বিদেশ থেকে আসবেন, তাদের অবশ্যই করোনা টেস্ট করাতে বলা হয়েছে। মাস্ক পরায় ফের বাধ্যবাধকতা আনা হচ্ছে।
জনসন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘যুক্তরাজ্যে প্রবেশের দুই দিনের মধ্যে যে কাউকে পিসিআর টেস্ট করাতে হবে। রেজাল্ট নেগেটিভ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে ব্যক্তিগতভাবে আইসোলেশনে থাকতে হবে।’
জার্মানির বাভারিয়ার রাজ্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও ওমিক্রনে সংক্রমিত দুই ব্যক্তির খবর দিয়েছে। বলা হয়েছে, ওই দুই ব্যক্তি ২৪ নভেম্বর মিউনিখ বিমানবন্দর দিয়ে জার্মানিতে প্রবেশ করেছিলেন।
আর ইতালির ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট বলছে, মিলানে এক ব্যক্তির দেহে ওমক্রিন শনাক্ত হয়েছে। ওই ব্যক্তি মোজাম্বিক থেকে এসেছেন।
চেক রিপাবলিক কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে, তাদের ওখানে এক ব্যক্তি ওমিক্রনে সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারেন। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ওই ব্যক্তি নামিবিয়ায় সময় কাটিয়ে এসেছেন।
নতুন ধরনটি কতটা বিপজ্জনক?
সার্স কভ টু ভাইরাসের নতুন ধরনটি নিয়ে গবেষকদের উদ্বেগের মূল কারণ, এর অনেকবারের মিউটেশন। মিউটেশন হলো এমন এক অভিযোজন কৌশল, যার মাধ্যমে ভাইরাস বিরূপ বা নতুন পরিস্থিতিতেও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে।
বিজ্ঞানীরা ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনে ৩২টি মিউটেশন খুঁজে পেয়েছেন। অন্যদিকে অত্যন্ত সংক্রামক হিসেবে বিবেচিত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে মিউটেশন হয়েছে মাত্র আটবার।
স্পাইক প্রোটিনের বেশি মিউটেশন মানেই ভাইরাসটি বেশি প্রাণঘাতী, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বহুবার মিউটেশনের কারণে ওমিক্রনের সঙ্গে মানুষের দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থার (ইমিউনিটি সিস্টেম) লড়াই করা কঠিন হতে পারে।
ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিন প্রচলিত করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের তুলনায় অনেকটা বদলে যাওয়ায় দেহের ইমিউনিটি সিস্টেম দ্রুত একে শনাক্ত করতে পারে না, ফলে এটি সংক্রমণের হার বাড়াতে পারে। যেকোনো করোনাভাইরাস এদের স্পাইকের সাহায্যেই শ্বাসতন্ত্রের কোষে যুক্ত হয়ে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে।
প্রাথমিক গবেষণা অনুসারে, নতুন ভ্যারিয়েন্টটি টিকার কার্যক্ষমতা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে সক্ষম।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টের দুটি মিউটেশন- আর ২০৩কে এবং জি ২০৪আর ভাইরাসটি দ্রুত প্রতিলিপি তৈরি করতে সক্ষম। এ ছাড়া তিনটি মিউটেশন- এইচ৬৫৫ওয়াই, এন ৬৭৯কে এবং পি ৬৮১এইচ ভাইরাসটিকে আরও সহজে মানব কোষে প্রবেশে সাহায্য করে। তারা বলছেন, শেষ দুটি মিউটেশনের একসঙ্গে উপস্থিতি বিরল ঘটনা এবং এর ফলে ওমিক্রন টিকা প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে।
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার ইনস্টিটিউট অফ মলিকুলার বায়োটেকনোলজির আণবিক জীববিজ্ঞানী ডা. উলরিচ এলিংয়ের মতে, প্রাথমিক লক্ষণ থেকে মনে হচ্ছে করোনার নতুন রূপটি ডেল্টার চেয়ে ৫০০ শতাংশ বেশি সংক্রামক হতে পারে।
অবশ্য নতুন ভ্যারিয়েন্টটি সার্স কভ টুর আগের ধরনগুলোর তুলনায় বেশি প্রাণঘাতী- এমন কোনো প্রমাণ এখনও মেলেনি। তবে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সক্ষমতার কারণে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নতুন করে চাপে ফেলতে পারে।