আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের ১০০ দিনে কট্টর তালেবানের আচরণে বেশি ভুগছে সুশীল সমাজ। নারী, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক সবাই নিজেদের অধিকার প্রশ্নে নীরব। যারাই গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছে, তাদের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ নিপীড়ন। বলতে গেলে দেশটির শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে পুরোপুরি।
চলতি বছরের ১৫ আগস্ট যেদিন কাবুল দখলে নেয় তালেবান, সেদিন থেকেই নিরাপত্তাহীনতায় দেশটির অসংখ্য মানুষ। তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ ১৭ আগস্ট প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রতিশোধের দিকে ঝুঁকবে না নতুন সরকার।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল তালেবান। ওই সময়ে তাদের কঠোর শাসনের বলি হয়েছিলেন অনেকে। এ ছাড়া ক্ষমতা হারানোর পর, দীর্ঘ ২০ বছরে সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল তাদের। এসব বিষয় মাথায় রেখে উদার নীতির বুলি আওড়েছিলেন তালেবান নেতারা।
কথা দিয়েছিলেন নারীদের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে না। মানবাধিকার রক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবেন তারা। আশ্বস্ত করেছিলেন ২০ বছর আগে যে নীতিতে দেশ শাসন করেছিলেন, তা থেকে সরে আসবে নতুন তালেবান সরকার।
কিন্তু কথা রাখেনি তালেবান। ক্ষমতা কিছুটা পোক্ত করার পরপর স্বরূপে ফেরে গোষ্ঠীটি। তাদের প্রথম টার্গেট হন নারীরা। বাদ যাননি মানবাধিকারকর্মী, বিচারক এমনকি সাংবাদিক।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, মানবাধিকার কাউন্সিল, সাধারণ অধিবেশনের পাশপাশি জি-সেভেন ও জি-টুয়েন্টি সম্মেলনেও ১৫ আগস্ট-পরবর্তী আফগানিস্তান নিয়ে উদ্বেগ জানাতে দেখা গেছে বিশ্বনেতাদের। কিন্তু দেশটিতে মানবাধিকার প্রশ্নে সমাধান দিতে পারেনি কেউ।
নারীর অধিকার কেড়ে নেয়া
ক্ষমতা দখলের ৩ দিন পর ১৮ আগস্ট তালেবান মুখপাত্র সুহিল শাহিন সংবাদমাধ্যমে বলেন, নারীদের শিক্ষা গ্রহণ ও চাকরি করার অধিকার আছে। তাই তারা এসব করতে পারবেন। চিকিৎসক, শিক্ষক ও অন্যান্য খাতের নারীরা নির্বিঘ্নে কাজ করে যাচ্ছেন। সাংবাদিকরাও হিজাব পরে তাদের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
কিন্তু প্রকৃত চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। সরকারে নারীদের রাখা তো দূরের কথা, নারীবিষয়ক যে মন্ত্রণালয়টি ছিল, তা কার্যত অচল রেখেছেন তালেবান শাসকরা। স্কুলে কেবল ছেলেরা যাচ্ছে। সরকারি চাকরিজীবী নারীদের বলা হয়েছে ঘরে থাকতে। টেলিভিশনের পর্দায় নারীর চেহারা দেখানো নিষিদ্ধ হয়েছে সম্প্রতি। অনেক প্রদেশে পুরুষ ছাড়া ঘর থেকে বেরুনোও মানা।
প্রাণহানির ঝুঁকিতে মানবাধিকারকর্মীরা
ভালো নেই আফগানিস্তানে কাজ করা মানবাধিকারকর্মীরা। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত ম্যারি লওলর সম্প্রতি ১০০ মানবাধিকারকর্মীর সঙ্গে কথা বলেন। তারা জানিয়েছেন, মারধর, গুম, গ্রেপ্তার এমনকি খুন হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন তারা। অনেক এনজিওর ব্যাংক হিসাব জব্দ করে রাখার অভিযোগও রয়েছে তালেবানের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া ফোনে হুমকি, সতর্ক করে চিঠিও দেয়া হচ্ছে অনেককে।
গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব
বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো কিছুই সহ্য করতে পারছে না তালেবান। করছে সহিংস আচরণ। অধিকার ফিরে পেতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা হয়েছে বেশ কয়েকটি।
১৮ আগস্ট শান্তিপূর্ণ সমাবেশ চলছিল জালালাবাদে। সেখানে আচমকা গুলি চালানো শুরু করে তালেবান। নিহত হন তিনজন। এদিন হেরাতেও নিহত হন তিনজন। কাবুল ও ফায়জাবাদের সমাবেশে অংশ নেয়াদের পেটানো হয় বেদম।
টার্গেটে সাংবাদিক, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সংবাদমাধ্যম
ক্ষমতা দখলের পর তালেবান জানিয়েছিল, দেশ শাসনে গণমাধ্যম তাদের বড় সহায়ক হবে। ভুলত্রুটিগুলো উঠে আসবে প্রতিবেদনে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, সমালোচনা নিতে পারছে না তালেবান।
দেশটির ২৮ প্রদেশের এক হাজার ৩৭৯ সাংবাদিকের ওপর চালানো জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশের বেশি সাংবাদিককে এরই মধ্যে নানা ধরনের হুমকি দেয়া হয়েছে। বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু ছাপাতে সাফ নিষেধ করেছে তালেবান।
জরিপে আরও দেখা গেছে, তালেবান ক্ষমতা নেয়ার পর ৬৭ শতাংশ সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন। ২০ প্রদেশে ১৫৩টি গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে।