যে বয়সে পৃথিবী থেকে মানুষের আর কিছুই চাওয়ার থাকে না, সেই বয়সে পুরোদস্তুর পদার্থবিদ হয়ে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ডের বাসিন্দা ম্যানফ্রেড স্টেইনার। এই স্বপ্ন তিনি বহু বছর ধরেই লালন করছিলেন। অবশেষে সফলতা এলো ৮৯ বছর বয়সে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হয় স্টেইনার তখনও কিশোর। পরিবারের সঙ্গে বেড়ে উঠছিলেন অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়। সেই সময়টিতেই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন আর ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সম্পর্কে পড়ে পদার্থবিদ হওয়ার বাসনা জাগে তার। কিন্তু চাইলেই তো আর হবে না, বাবা-মায়ের ইচ্ছা বলেও একটি ব্যাপার থাকে। তাই মায়ের ইচ্ছায় শেষ পর্যন্ত মেডিসিন নিয়েই পড়াশোনা করতে হয় স্টেইনারকে। অশান্ত সেই সময়টিতে চিকিৎসক হতে পারা ছিল অনেক বড় একটি ব্যাপার।
১৯৫৫ সালে ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনা থেকে মেডিসিনের ওপর ডিগ্রি নেন স্টেইনার। এর কয়েক সপ্তাহ পরই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। সেখানে রক্ত ও রক্তের নানা সমস্যা নিয়ে পড়াশোনা করে সফল ক্যারিয়ার গড়েন।
পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের টাফ্ট ইউনিভার্সিটিতে হেমাটোলজি এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে বায়োকেমেস্ট্রি নিয়েও পড়াশোনা করেন স্টেইনার। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে হেমাটোলজিস্ট হিসেবে যোগ দেন তিনি। পরে ফুল প্রফেসর হয়ে ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত এই বিভাগের নেতৃত্ব দেন।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলাইনাতেও হেমাটোলজি বিষয়ে একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু করেন স্টেইনার। ২০০০ সালে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই প্রকল্প পরিচালনা করেছেন তিনি। অবসরের পর রোড আইল্যান্ডে গিয়ে থিতু হন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে এত সাফল্য অর্জন আর সময় ব্যয় করলেও পদার্থবিদ হওয়ার বাসনা কোনো কালেই ফুরোয়নি স্টেইনারের। ভিয়েনা ইউনিভার্সিটিতে তিনি যখন মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন, তখন তার বিভাগ থেকে হাঁটাপথ দূরত্বে ছিল পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ। ফাঁক পেলেই তিনি সেখানে গিয়ে বসে থাকতেন। চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে একসময় ব্যস্ত হয়ে গেলেও পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে জানার আগ্রহ তার অতৃপ্ত বাসনার মতো থেকে যায়।
তাই অবসর নেয়ার পর ৭০ বছর বয়সে তিনি ব্রাউন ইউনিভার্সিটির স্কুলপর্যায়ে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হয়ে যান। পদার্থবিজ্ঞানের যেসব বিষয়ের প্রতি তিনি আগ্রহবোধ করতেন সেসব বিষয় সম্পর্কে জানাই ছিল তার লক্ষ্য। কিন্তু ২০০৭ সালের মধ্যে এই বিষয়ে তিনি যে পরিমাণ নম্বর যোগ করেন তা তাকে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়ার অনুমোদন দিয়ে দেয়।
স্টেইনারের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ব্র্যাড মার্সটন বিষয়টিকে প্রথমে বুড়ো মানুষের ভীমরতি মনে করলেও পরে তার বিস্ময়ের সীমা ছিল না। বুঝতে পারেন অন্য যেকোনো শিক্ষার্থীর চেয়ে স্টেইনার অনেক বেশি মনোযোগী।
স্টেইনারের পিএইচডি প্রবন্ধের অ্যাডভাইজারও হন মার্সটন। কিন্তু বয়সের কারণে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হয় স্টেইনারের। এসব সমস্যা মোকাবিলা করে অবশেষে গত সেপ্টেম্বরে তিনি তার দেড় শ পৃষ্ঠার গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এই প্রবন্ধে তিনি ব্যাখ্যা করেন, ঠিক কীভাবে পরিবাহী ধাতুগুলোর মধ্যে থাকা ইলেকট্রনগুলো যান্ত্রিকভাবে কোয়ান্টাম আচরণ করে এবং ফার্মিয়নগুলো কীভাবে তাদের আচরণে বোসনে পরিবর্তিত হয়।
গিনেস বুকে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে পিএইচডি করার রেকর্ডটি এক জার্মানের দখলে। ২০০৮ সালে ৯৭ বছর বয়সে তিনি এই ডিগ্রি নিয়েছিলেন।
রেকর্ড না গড়লেও স্টেইনারের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কারণ তিনি তার জীবনের প্রায় পুরোটা সময় ভিন্ন আরেকটি বিষয়ে পড়াশোনা এবং চাকরি করেছেন।
স্টেইনারের পিএইচডি ডিগ্রিকে সম্মান জানিয়ে নিজস্ব ওয়েবসাইটে তার ছবি প্রকাশ করেছে ব্রাউন ইউনিভার্সিটি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এত বড় অর্জনের পর স্টেইনারের পরামর্শ হলো- ‘তাই করুন, যা আপনি ভালোবাসেন।’