উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদানে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে মঙ্গলবারও বিক্ষোভ অব্যাহত আছে। বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় প্রাণ গেছে কমপক্ষে সাতজনের।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্থিতিশীলতা চরমে ওঠায় কার্যত অচল রাজধানী খার্তুম। দেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর নীল নদ-তীরবর্তী ওমদারমানেও জীবনযাত্রা থমকে গেছে।
সব সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হয় সেনাবাহিনী অবরুদ্ধ করে রেখেছে, না হলে বিক্ষোভকারীরা ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। সড়কে যান চলাচল বন্ধ, দোকানপাট বন্ধ, ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
মসজিদ থেকে লাউড স্পিকারে উচ্চ স্বরে জনগণকে ডাক দেয়া হচ্ছে সাধারণ ধর্মঘটে অংশ নেয়ার জন্য।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সাংগঠনিক জোট সুদানিজ প্রফেশনালস অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বানে হচ্ছে এ ধর্মঘট।
খার্তুম ও ওমদারমান শহরের প্রধান সংযোগ সড়ক ও সেতু অবরোধ করেছে সেনাবাহিনী, মোতায়েন রয়েছে সাঁজোয়া যান। পশ্চিমাঞ্চলীয় আল গিনেইনা শহরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা। স্কুল, দোকানপাট, গ্যাস স্টেশনসহ সবকিছু বন্ধ।
শহরগুলোতে সব ব্যাংক ও যান্ত্রিক ব্যবস্থায় নগদ সরবরাহ কার্যক্রম বন্ধ। অর্থ স্থানান্তরে ব্যবহৃত মোবাইল অ্যাপেও ঢুকতে পারছেন না গ্রাহকরা।
ওমদারমানে কয়েকটি বেকারি খোলা থাকলেও জোগান না থাকায় খাবারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা সারি বেঁধে অপেক্ষারত মানুষ।
এক দিন আগেই সুদানের বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে শাসনব্যবস্থার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনাবাহিনী। ভেঙে দিয়েছে সরকার।
সোমবার দিনভর অস্থিতিশীলতার পর রাত কিছুটা শান্ত ছিল। প্রধানমন্ত্রী আব্দাল্লাহ হামদককে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ফের রাজপথে নেমে আসেন বিক্ষোভকারীরা। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও মন্ত্রিসভার অন্য বেসামরিক নেতাদেরও আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নেয়া হয়েছে।
সেনা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। সাবেক স্বৈরশাসক ওমর আল-বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে সুদান শাসন করা সার্বভৌম পরিষদের প্রধান ছিলেন তিনি। ক্ষমতা দখল করেই পরিষদটি ভেঙে দেন আল-বুরহান।
সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সুদান শাসন করেছে বশির সরকার। টানা ৩০ বছর দেশ শাসনের পর প্রবল গণ-আন্দোলনের জেরে ২০১৯ সালে বশিরের পতন ঘটে। এরপরই সুদানকে গণতন্ত্রের পথে দিকনির্দেশনা দেয়ার লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছিল সামরিক-বেসামরিক সার্বভৌম পরিষদ।
এদিকে জননিরাপত্তার স্বার্থে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করার কথা জানিয়েছেন বুরহান। আশ্বাস দিয়েছেন ২০২৩ সালের জুলাইয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের।
বিভিন্ন আরব সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, শ্রমিক ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে থাকা কমিটিগুলোও ভেঙে দিয়েছেন এই সেনা কর্মকর্তা।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী হামদকের প্রতি বিশ্বস্ত সুদানের তথ্য মন্ত্রণালয় নিজেদের ফেসবুক পেজে জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সংবিধান অনুযায়ী জরুরি অবস্থা জারির অধিকার একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর। তাই সংবিধান লঙ্ঘন করে এ পদক্ষেপ নিয়ে অপরাধ করেছে সেনাবাহিনী। হামদক এখনও বৈধ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান।
তথ্য মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলে অনুমোদনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় গ্রেপ্তার করা হয় হামদককে। অর্থনীতিবিদ ও জাতিসংঘের সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন তিনি।
সুদানে সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। অবিলম্বে বেসামরিক নেতাদের মুক্তি দেয়া না হলে বিদেশি সহায়তা বন্ধের হুমকিও দেয়া হয়েছে অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত দেশটিকে। ৭০ কোটি ডলারের জরুরি সহায়তা তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
উপনিবেশ-পরবর্তী সুদানের বড় সময় কেটেছে সামরিক শাসনে। অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বরাবর দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনাবাহিনী। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন একঘরে ছিল দেশটি।
নিষিদ্ধঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনকে নব্বইয়ের দশকে আশ্রয় দেয়ার জন্য বশিরশাসিত সুদান যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকাভুক্ত ছিল। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সুইজারল্যান্ডের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতও বশিরকে ডেকে পাঠিয়েছিল।
বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ক্ষমতা বণ্টনের শর্তে সম্মিলিত অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছিলেন সেনাবাহিনী ও বেসামরিক নেতারা। ২০২৩ সালে নির্বাচনের লক্ষ্য নিয়ে গঠিত ওই সরকারের মধ্যে নানা বিষয়ে বিভক্তি ছিল।
বিশেষ করে গত মাসে বশির সমর্থকদের ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার পর পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারে ফাটল তীব্র হয়।