সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক বিভক্তি সৃষ্টি, শিশুদের ক্ষতি, নিরাপত্তার চেয়ে মুনাফাকে বেশি অগ্রাধিকার দেয় বলে অভিযোগ তুলেছেন প্ল্যাটফর্মটির সাবেক এক কর্মকর্তা।
সিবিএসকে সোমবার দেয়া সাক্ষাৎকারে ফেসবুকের সাবেক প্রোডাক্ট ম্যানেজার ফ্রান্সেস হাউগেন গণতন্ত্র দুর্বল করাসহ প্ল্যাটফর্মটির বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ এনেছেন।
অবশ্য তার এসব অভিযোগ পরের দিনই প্রত্যাখ্যান করেছেন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মার্ক জাকারবার্গ।
বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
জাকারবার্গ বলেন, ‘ফেসবুক ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তার চেয়ে প্রতিষ্ঠানের মুনাফার দিকে আমাদের ঝোঁক বেশি থাকার অভিযোগ সত্য নয়।
‘মানুষ খেপে যেতে পারে এমন কনটেন্ট আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি রাখি আর এসব থেকে আমরা মুনাফা কামাই, এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।’
তিনি বলেন, ‘এমন কোনো প্রযুক্তি কোম্পানির কথা আমার জানা নেই যেটি মানুষকে রাগান্বিত বা বিষণ্ন করার মতো পণ্য তৈরি করার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ব্যবসা ও পণ্যের প্রণোদনার অবস্থান সব দিক থেকেই বিপরীতমুখী।’
সিক্সটি মিনিটস নামে সিবিএসের অনুষ্ঠানে হাউগেন বলেন, ‘আমরা এমন একটি তথ্যনির্ভর পরিবেশে আছি, যা ক্ষোভ, বিদ্বেষ এবং বিভেদের কনটেন্ট দিয়ে ভর্তি। এটি আপনার নাগরিক বিশ্বাসকে ক্ষয় করতে থাকে, একে অন্যের ওপর আস্থা নষ্ট করতে থাকে।
‘আমাদের একে অন্যের যত্ন নেয়ার ক্ষমতা কমাতে থাকে। ফেসবুকের যে সংস্করণটি এখন আছে সেটি আমাদের সমাজব্যবস্থাকে ছিঁড়ে ফেলছে। এটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিগত সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে।’
এ বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ‘ফেসবুক ফাইলস’ নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির ফাঁস হওয়া বিভিন্ন নথি প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করে আসছিল ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। এই নথিগুলো কে সংগ্রহ করেছিলেন সেটি অজানা ছিল।
সিক্সটি মিনিটসের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমেই ফেসবুকের নথি ফাঁসকারী হিসেবে নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন ফ্রান্সেস হাউগেন।
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন চলার সময় ভুয়া তথ্যের প্রচার ঠেকাতে সাময়িকভাবে নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থা চালু রেখেছিল ফেসবুক।
হাউগেন বলেন, ‘নির্বাচন শেষ হওয়ার পরই তারা সেটি বন্ধ করে দিয়েছিল অথবা সেটিংস পাল্টে আগের অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল। এটি সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা মনে হয়েছে।’
হাউগেনের অভিযোগ মুনাফার জন্য নেতিবাচক উদ্দেশ্যে অ্যালগরিদম ঠিক করে ফেসবুক। প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের নিয়ে যে ইতিবাচক প্রচার চালায় তার সঙ্গে এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ফেসবুক জানে, সবচেয়ে বেশি ট্রাফিক পাওয়া যায় বিদ্বেষমূলক কনটেন্টে। এমন কনটেন্টের ওপরেই ফেসবুকের বড় অংশের আয় নির্ভর করে।
তিনি বলেন, ‘আপনার হাতে যখন এমন ব্যবস্থা থাকবে যা রাগ দিয়ে হ্যাক করা যায়, আর প্রকাশকরা যখন ভাবে যে, ওহ আমি যদি আরও বেশি আক্রমণাত্মক, বিদ্বেষমূলক কনটেন্ট দিই তাহলে বেশি টাকা কামাব; তখন পুরো বিষয়টি ফেসবুকের জন্যেও লাভজনক এবং প্রকাশকদের জন্যও লাভজনক। ফেসবুক এমন একটা প্রণোদনা ব্যবস্থা তৈরি করেছে যা মানুষকে পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে।’
সাক্ষাৎকারে হাউগেন বলেন, ‘ফেসবুকে আমি যেটা বারবার দেখেছি সেটা হলো, জনসাধারণের জন্য কোনটা ভালো আর ফেসবুকের জন্য কোনটা ভালো, এর মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। আর ফেসবুক প্রতিবারই আরও বেশি মুনাফা অর্জনের মতো নিজের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছে।’
হাউগেনের এই সাক্ষাৎকারের পর সোমবার রাতে হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ। সার্ভারে কারিগরি ত্রুটির কারণে বন্ধ হওয়ার প্রায় ছয় ঘণ্টা পর মঙ্গলবার ভোর থেকে চালু হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো।
এ সময় অনেকেই এ ঘটনার সঙ্গে হাউগেনের সাক্ষাৎকারের যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেন। তবে একে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।