সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ২০২০ সালের ৫ মে প্রকাশিত পোস্টে দাবিটি করা হয়। ৫৫০ বারের বেশি শেয়ার হওয়া পোস্টটিতে বলা হয়, বিশ্বের প্রথম টিকাটির উদ্ভাবন হয়েছিল অটোমান সাম্রাজ্যে, ১৭১৭ সালে।
বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্দোনেশীয় ভাষায় লেখা পোস্টটি অসত্য।
পোস্টে যুক্ত ছবির ক্যাপশনে যা লেখা রয়েছে, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়:
“টিকা
প্রথমবার টিকা তৈরি করা হয়েছিল অটোমান খেলাফতে। ১৭১৭ সালে ইস্তাম্বুলের তৎকালীন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী লেডি মেরি মন্টাগু তার বন্ধুদের একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। ওই চিঠিতে তিনি জানান, ইস্তাম্বুলে গুটিবসন্ত আক্রান্তদের চিকিৎসায় ‘টিকা কার্যক্রম’ বলে কিছু একটা চলছে।
“লেডি মেরি জানান, নারী ও শিশুদের একটি জায়গায় একত্রিত করা হচ্ছে। তাদের বাহুতে ফুটো করে কিছু দেয়া হয়েছে। এরপর তারা মৃদু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। এই চিঠিটি টিকার উৎপাদন ও ব্যবহারবিষয়ক প্রাচীনতম নথি। চিঠিটি লেখা হয়েছিল ১৭১৭ সালের ১ এপ্রিল।”
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটিনিকা থেকে জানা যায়, লেডি মেরি ওর্টলি মন্টাগু ছিলেন একজন লেখিকা ও নারীবাদী। ১৭১৬ সালে অটোমান সাম্রাজ্যে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত এডওয়ার্ড ওর্টলি মন্টাগুর স্ত্রী ছিলেন তিনি।
ফেসবুকে ছবিটি আরও কমপক্ষে চারবার প্রকাশ করে পোস্টগুলোতে একই দাবি করা হয়েছে। পোস্টগুলো শেয়ার করেছেন ১৮০ জনের বেশি ব্যবহারকারী।
দাবিটি সঠিক নয়। কারণ ইতিহাসের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, টিকার উদ্ভাবক ব্রিটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার। ১৭৯৬ সালে টিকা উদ্ভাবন করেন তিনি, যা বিশ্বের প্রথম।
তার আগে চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগ প্রতিরোধে রোগ সৃষ্টিকারী উপাদান ত্বকের ভেতরে কৃত্রিমভাবে প্রবেশ করানো হতো, যা ইংরেজিতে ‘ভ্যারিওলেশন’ বা ‘ইনোকুলেশন’ হিসেবে পরিচিত ছিল।
১৭৯৬ সালে জেনার ‘ভ্যারিওলেশন’ প্রক্রিয়ার বিকল্প হিসেবে গুটিবসন্তের প্রথম সফল টিকা আবিষ্কার করেন। যা পরে আধুনিকায়ন করা হয় বলে জানায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনস।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় বলা আছে, ‘গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য গরু থেকে মানবদেহে ছড়ানো এক ধরনের বসন্ত সৃষ্টিকারী ভাইরাস ব্যবহার করে টিকা তৈরি করেছিলেন ব্রিটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার। সেটিই বিশ্বের প্রথম টিকা। সালটি ১৭৯৬।’
লেডির মেরি ওর্টলি মন্টাগুর চিঠি
এ কথা সঠিক যে লেডি মেরির লেখা একটি চিঠিতে টিকার উল্লেখ ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সট্যান্টিনোপলে বসে চিঠিটি লিখেছিলেন তিনি, তারিখ ১৭১৭ সালের ১ এপ্রিল। নিউইয়র্ক অ্যাকাডেমি অফ মেডিসিন লাইব্রেরি ব্লগে ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ চিঠিটি প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক আমেরিকান সেন্টার ফর হিস্ট্রি।
লন্ডনে বন্ধু সারাহ কিসওয়েলকে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন লেডি মেরি। অটোমান সাম্রাজ্যে গুটিবসন্তের চিকিৎসা কীভাবে করা হতো, চিঠির একটি অংশে সে বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
সেখানে যা লেখা আছে তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘হাতে বড় একটি সূঁচ ঢোকানো হতো। সূঁচের মাথায় যতটুকু বিষয় রাখা সম্ভব হতো, ততটুকুই সূচের মাধ্যমে শিরায় ঢুকিয়ে দেয়া হতো। এ প্রক্রিয়ায় সাধারণ আঁচড়ের চেয়ে বেশি ব্যথা হতো না।’
লেডি মেরির বর্ণিত প্রক্রিয়াটি তৎকালীন চিকিৎসা ব্যবস্থায় ‘ভ্যারিওলেশন’ বলে পরিচিত ছিল বলে কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস অফ ফিলাডেলফিয়ার হিস্ট্রি অফ ভ্যাকসিনসের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা আছে।
সেখানে বলা আছে, ‘ভ্যারিওলেশন’ প্রক্রিয়াটি ‘ইনোকুলেশন’ নামেও পরিচিত চিল। ইউরোপের অনেক আগে থেকে প্রক্রিয়াটির চর্চা ছিল চীন, আফ্রিকা ও অটোমান সাম্রাজ্যে।
প্রক্রিয়াটিকে ইংল্যান্ডে পরিচিত করে তোলার কৃতিত্ব দেয়া হয় লেডি মেরিকে। ইংল্যান্ডে ১৭২১ সালে এক চিকিৎসকের মাধ্যমে নিজের মেয়ের দেহে ‘ভ্যারিওলেশন’ পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন মেরি।
ভ্যারিওলেশন প্রক্রিয়ায় মৃদু গুটিবসন্তে আক্রান্ত রোগীর দেহে সৃষ্ট ফুসকুড়ির ক্ষুদ্র কণা সংগ্রহ করা হতো এবং গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে দেহে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ওই জীবাণু সূঁচের মাধ্যমে রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হতো।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনসের তথ্য অনুযায়ী, ‘ভ্যারিওলেশন কখনোই ঝুঁকিমুক্ত ব্যবস্থা ছিল না। এই প্রক্রিয়ায় রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি তো থাকেই, একই সঙ্গে জীবাণুর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তির মাধ্যমে রোগটি ছড়ানোর ভয়ও থাকত যা পরে মহামারির কারণও হতে পারত।
‘তৎকালীন সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেই ভ্যারিওলেশন প্রক্রিয়ার বলি হওয়া মানুষ ছিল। এ প্রক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছিল রাজা তৃতীয় জর্জের ছেলের।’