বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

৯ বছরে ৬ বার পরাজিত ক্যানসার

  •    
  • ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ২২:৪৫

২০২০ সালের নভেম্বরে ষষ্ঠবার ক্যানসার শনাক্তের পর অস্থিমজ্জা স্থানান্তরের জটিল চিকিৎসার যন্ত্রণাও সহ্য করতে হয় জয়ন্তকে। তিনি বলেন, ‘ছয়বার ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেছি। প্রায় প্রতিবারই দেহের নতুন কোনো অংশ আক্রান্ত হয়েছে। যতবার অসুস্থ হয়েছি, আত্মীয়রা আমার মা-বাবাকে পরামর্শ দিয়েছিল কোনো হাসপাতালে আমাকে ফেলে রেখে আসতে। তারা ভেবেছিল যে আমি যেহেতু বাঁচবোই না, শুধু শুধু কেন আমার বোঝা টানবেন আমার মা-বাবা।’

২৩ বছর বয়সী ভারতীয় যুবক জয়ন্ত কানড়োইয়ের ওজন মাত্র ৩৬ কেজি, কিন্তু তার কণ্ঠের বলিষ্ঠতায় স্পষ্ট লড়াকু ব্যক্তিত্ব। জয়ন্তর প্রতিদ্বন্দ্বী সহজ কেউ নয়। প্রাণঘাতী রোগ ক্যানসারের সঙ্গে তার লড়াই চলছে কিশোর বয়স থেকে। জীবন জয়ের যুদ্ধে গত নয় বছরে ছয়বার ক্যানসারকে হারিয়েছেন তিনি।

জয়ন্ত জানান, গত নয় বছরে গুণে গুণে এক হাজার ২৩৭ দিন বা প্রায় চার বছরই হাসপাতালে কেটেছে তার। ক্যানসারকে জিততে না দিলেও তার শরীরজুড়ে রোগটির ধ্বংসলীলা। ১৭টি কেমোথেরাপি, ৬০টির বেশি রেডিওথেরাপি আর অস্থিমজ্জা স্থানান্তরের মতো কঠিন চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।

একের পর এক অস্ত্রোপচার, আর শরীর-মনের শক্তি নিংড়ে নেয়া ওষুধ, আর স্বাস্থ্যপরীক্ষার কষ্টকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছেন জয়ন্ত। তার কাছে ক্যানসার এখনও অজেয়।

টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য রাজস্থানের আজমির শহরের বাসিন্দা জয়ন্ত। ২০১৩ সালে যখন দশম শ্রেণির ছাত্র সে, তখন প্রথম ক্যানসার ধরা পড়ে তার।

তিনি বলেন, ‘ঘাড়ের ডান দিকে মাংসপিণ্ডর মতো কিছু একটা অনুভব করি। পরে জানা যায়, এটা ক্যানসার। সেই প্রথম হজকিন লিম্ফোমার নাম শুনি আমি। কোনো ব্যথা ছিল না। কিন্তু দিন দিন মাংসপিণ্ডটি বড় হচ্ছিল।

‘প্রথমবার অপারেশন থিয়েটার দেখি আমি সে সময়। ভয় পাইনি একটুও। জয়পুরের ভগবান মহাবীর ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি হই। অস্ত্রোপচারের পর শুরু হয় কেমোথেরাপির ধাক্কা। ছয়টি কেমোথেরাপি নিয়ে ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথম আমাকে ক্যানসারমুক্ত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। সেই দিনটির সব স্মৃতি আজও চোখে ভাসে আমার।’

এরপর জয়পুর থেকে আজমিরে ফেরেন জয়ন্ত, অংশ নেন মাধ্যমিক পরীক্ষায়, নিজ ক্লাসে প্রথম হন তিনি। গর্ব নিয়ে জয়ন্ত বলেন, ‘শিক্ষাজীবনের পুরো সময়েই প্রথম সারির শিক্ষার্থী ছিলাম আমি।’

এসবের মধ্যেই ক্যানসারমুক্ত জয়ন্ত তীব্র ক্লান্তিতে ভুগতেন। এতটাই যে লম্বা সময়ের জন্য স্কুলেও যেতে পারছিলেন না। অথচ পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত একটি দিনও স্কুল বাদ না দেয়ার রেকর্ড ছিল তার।

একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় জয়ন্তর দেহে আরেকটি মাংসপিণ্ড ধরা পড়ে; এবার ঘাড়ের বাম পাশে। ২০১৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আবারও ভগবান মহাবীর ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে শুরু করেন।

জয়ন্ত কখনোই নিজের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটতে দেননি। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উৎরে যান এসবের মধ্যেই, বিকমে পড়াশোনা শুরু করেন।

জয়ন্ত বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০১৭ সালের শুরুতে আবারও ক্যানসার ধরা পড়ে আমার শরীরে, এবার অগ্ন্যাশয়ে। প্রায়ই পেটে অসহ্য ব্যথা হতো। পরিস্থিতি চরমে পৌঁছায় শেষ বর্ষে পড়াশোনার সময়। দিল্লিতে একা থাকছিলাম বলে বাবা আমাকে দ্রুত বাড়িতে ফিরে চিকিৎসা শুরু করার অনুরোধ করেন।’

দ্য বেটার ইন্ডিয়ার জুলাই মাসের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অসুস্থতা মারাত্মক রূপ নেয়ায় পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই ২০১৭ সালে আজমিরে ফেরেন জয়ন্ত। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা শেষ না করে বাড়ি ফেরার কারণে খুব কষ্টে ছিলাম। কিন্তু ব্যথাও সহ্য করতে পারছিলাম না। ভেঙেচুরে যাচ্ছিলাম মনে হতো।’

সেবার চিকিৎসকরা জানান, অগ্ন্যাশয়ের টিউমারে পৌঁছাতে জয়ন্তর পেটে নয় ইঞ্চি লম্বা ফুটো করতে হবে।

জয়ন্ত বলেন, ‘সেবারই প্রথম বাবার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখলাম। টিউমারটা মাত্র এক সেন্টিমিটার ছিল। কিন্তু পাকস্থলীর যে অংশে এটি ছিল, সে অংশটি কেটে ফেলে দিতে হবে- এই চিন্তা আমার বাবাকে কুড়ে খাচ্ছিল।’

অগ্ন্যাশয়ে টিউমার ধরা পড়ার দুই বছর পর কেমোথেরাপিসহ সব চিকিৎসা শেষ করেন জয়ন্ত। তৃতীয়বার ক্যানসারকে হারিয়ে বাড়ি ফিরেই নতুন উদ্যমে শুরু করেন পড়াশোনা। সশরীরে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রমে নাম লেখান তিনি, সম্পন্ন করেন স্নাতক।

জয়ন্তর বাবা ৫৭ বছর বয়সী অশোক কানড়োই বলেন, ‘পড়াশোনার জন্য ছেলেকে আবারও দূরে পাঠানোর ঝুঁকি নিতে চাইনি। ওর ডিগ্রির চেয়ে জীবন বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নয় বছর ধরে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু সন্তানের সুস্বাস্থ্য চেয়েছি। তাই চেয়ে যাব আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।’

২০১৯ সালে আবারও অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত হন জয়ন্ত; ২০১৭ সালে যেখানে ক্যানসার ধরা পড়েছিল, ঠিক সেই একই জায়গায় ধরা পড়ে নতুন টিউমার।

চতুর্থবার ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার পরও মুখের হাসি মুছতে দেননি জয়ন্ত। দীর্ঘযুদ্ধে শরীর ভেঙে পড়লেও আবারও চিকিৎসা শুরু করেন; আবারও জয়ী হয়ে ফেরেন।

গত দুই বছরে অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার আর দেখা দেয়নি। কিন্তু গত বছর জয়ন্তর ডান হাতের বগলের নিচে আরেকটি টিউমার ধরা পড়ে। এবার ছেলেকে নিয়ে আহমেদাবাদের গুজরাট ক্যানসার হাসপাতালে যান বাবা।

জয়ন্ত বলেন, ‘২০২০ সালের ২০ মার্চ চিকিৎসা শেষে আজমিরে নিজের বাড়িতে ফিরলাম। পরদিন থেকে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে লকডাউন শুরু হলো। অস্ত্রোপচারপরবর্তী চিকিৎসার জন্য আহমেদাবাদ যাওয়ার দরকার হলেও আর যেতে পারিনি।’

ক্যানসারের পঞ্চম আঘাত থেকে সেরে উঠতে না উঠতেই আট মাসের ব্যবধানে জয়ন্ত জানতে পারেন ষষ্ঠবারের মতো শরীরে বাসা বেঁধেছে হতচ্ছাড়া রোগটি। সময় ২০২০ সালের নভেম্বর। এবার ক্যানসারের আক্রমণস্থল তলপেট।

এই সময় অস্থিমজ্জা স্থানান্তরের জটিল চিকিৎসার যন্ত্রণাও সহ্য করতে হয় জয়ন্তকে। শরীরে সুঁই ঢোকাতে ভয় না পেলেও মেরুদণ্ডের নিচ থেকে অস্তিমজ্জা বের করে আনার সময় অসহনীয় ব্যথা সহ্য করতে হয়েছিল তাকে।

জয়ন্ত বলেন, ‘ছয়বার ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেছি। প্রায় প্রতিবারই দেহের নতুন কোনো অংশ আক্রান্ত হয়েছে। যতবার অসুস্থ হয়েছি, আত্মীয়রা আমার মা-বাবাকে পরামর্শ দিয়েছিল কোনো হাসপাতালে আমাকে ফেলে রেখে আসতে। তারা ভেবেছিল যে আমি যেহেতু বাঁচবোই না, শুধু শুধু কেন আমার বোঝা টানবেন আমার মা-বাবা।

‘আজ যখন আমি অন্যদের বাঁচতে উৎসাহ দিই, আমার ওই আত্মীয়-স্বজনরা হাঁ করে তাকিয়ে শোনে। তারা আজ আমাকে ভাগনে ডেকে যোগাযোগ করতে চায়।’

পুরো যাত্রা শুধু জয়ন্তর জন্য নয়, তার পরিবারের জন্যও একইরকম ক্লান্তিকর ছিল। শারীরিক ব্যথা সহ্য করেছেন তিনি, একইরকম মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছে তার পুরো পরিবার। এখন সবাই খুশি।

ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা তৈরি, দুঃস্থদের চিকিৎসায় তহবিল সংগ্রহ, ক্যানসারে আক্রান্তদের মনোবল বাড়ানো ইত্যাদি লক্ষ্য নিয়ে বন্ধুদের সহযোগিতায় একটি দাতব্য সংগঠন গড়ে তুলেছেন জয়ন্ত। সংগঠনটিতে বর্তমানে ৩৫০ জন নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবক আছেন।

এ বিভাগের আরো খবর