আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের কৃতিত্ব নিয়ে বড় ধরনের অন্তর্কোন্দলে জড়িয়েছে শাসক দল তালেবান।
দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে রীতিমতো ঝগড়া ও বাগ্বিতণ্ডা হয়েছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন জ্যেষ্ঠ এক তালেবান নেতা।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্মভিত্তিক সংগঠনটির সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আব্দুল গনি বারাদারের সঙ্গে বিবাদে জড়ান মন্ত্রিসভার এক সদস্য। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে তর্কের একপর্যায়ে পরস্পরের প্রতি উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ও করেন তারা।
গত কয়েক দিন লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছেন বারাদার। এ অবস্থায় তালেবানের শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যায়ে বিভেদ চলছে বলে অনিশ্চিত সূত্রে বিভিন্ন খবর শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু সংগঠনের পক্ষ থেকে সেসব খবর ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছিল তালেবান।
গত ১৫ আগস্ট রাজধানী কাবুল দখলের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের প্রায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় কট্টরপন্থি তালেবান, দেশকে ঘোষণা করে ‘ইসলামিক আমিরাত’ হিসেবে। তাদের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিসভা পুরুষ সদস্যসর্বস্ব।
এ মন্ত্রিসভা কট্টরপন্থি ও জ্যেষ্ঠ তালেবান নেতাদের নিয়ে গঠিত। এদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ওপর হামলার অভিযোগও আছে।
এতদিন সম্ভাব্য সরকারপ্রধান হিসেবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থাকা আব্দুল গনি বারাদারের বদলে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী করা হয় জাতিসংঘের কালো তালিকাভুক্ত মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দকে। বারাদার হয়েছেন আখুন্দের উপপ্রধান।
তালেবানের অভ্যন্তরীণ সূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি পশতু জানিয়েছে, বারাদারের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে নতুন তালেবান সরকারের শরণার্থীবিষয়ক মন্ত্রী ও নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হাক্কানি নেটওয়ার্কের অন্যতম নেতা খলিল উর-রহমান হাক্কানির। এর আগে বিবাদে জড়িয়েছিলেন দুই নেতার সমর্থকরা।
কাতারে কর্মরত এক জ্যেষ্ঠ তালেবান সদস্য ও বিবদমান দুই নেতার ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তিও বারাদার ও খলিল হাক্কানির বিবাদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ ঘটনা ঘটেছে গত সপ্তাহে।
সূত্রের দাবি, ২০ বছর পর আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখল ও দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠনের কৃতিত্ব কার, দ্বন্দ্বের সূত্রপাত মূলত সে প্রশ্নে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো নিয়েও অসন্তুষ্ট উপপ্রধানমন্ত্রী বারাদার।
সূত্রের মতে, আফগানিস্তানের বিভিন্ন সংকট সমাধানে বারাদার তার সমকক্ষ দলনেতাদের নিয়ে সরকারের কূটনৈতিক কার্যক্রমের ওপর জোর দিতে চান। বিপরীতে তালেবান সরকারে থাকা হাক্কানি গোষ্ঠীর সদস্য ও সমর্থকরা মনে করেন, কূটনীতি নয়, লড়াই করেই সব দাবি পূরণ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে সক্ষম প্রথম তালেবান নেতা বারাদার। ২০২০ সালে সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপ হয় তালেবান সহপ্রতিষ্ঠাতার। এর আগে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার ইস্যুতে হওয়া দোহা চুক্তিতে তালেবানের পক্ষে স্বাক্ষর করেন বারাদার।
অন্যদিকে, প্রভাবশালী হাক্কানি নেটওয়ার্ক আফগানিস্তানে সবচেয়ে সহিংস হামলার কয়েকটিতে সরাসরি জড়িত ছিল। আফগান সেনা ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের ওপর গত কয়েক বছরে সেসব হামলায় প্রাণ গেছে শতাধিক মানুষের। যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকায় সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হাক্কানি নেটওয়ার্ক।
হাক্কানির নেতৃত্বে থাকা অন্যতম শীর্ষ তালেবান নেতা সিরাজুদ্দিন হাক্কানি নবগঠিত অন্তর্বর্তী আফগান সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তালেবান সূত্র জানিয়েছে, বিবাদের পর রাজধানী কাবুল ছেড়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর কান্দাহারে গেছেন বারাদার। বর্তমানে সেখানেই অবস্থান করছেন তিনি।
বারাদারকে কিছুদিন ধরে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না বলে মাঝে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়েছিল যে তিনি মারা গেছেন। এ অবস্থায় সোমবার প্রকাশিত একটি অডিও বার্তায় বারাদারকে বলতে শোনা যায় যে তিনি সফরে আছেন। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি যেখানেই থাকি না কেন, আমরা সবাই ভালো আছি।’
কিন্তু অডিওর কণ্ঠটি বারাদারেরই কি না, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি বিবিসি। তালেবানের বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইটে রেকর্ডটি প্রকাশ করা হয়েছে।
দলের ভেতরে কোনো কোন্দল হয়নি দাবিতে এখনও অনড় তালেবান। সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে বারাদার নিরাপদে আছেন।
কিন্তু বারাদার কোথায় আছেন, কী করছেন- সেসব প্রশ্নের উত্তরে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন তালেবান নেতারা।
এক মুখপাত্র বলেছিলেন যে তালেবানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হায়বাতুল্লাহ আখুনজাদার সঙ্গে দেখা করতে কান্দাহারে গিয়েছেন বারাদার। পরে আবার ওই মুখপাত্রই বিবিসি পশতুকে বলেন যে বারাদার ‘ক্লান্ত, তাই বিশ্রামে আছেন’।
তালেবানের এসব বিবৃতিতে বিশ্বাস না করার পেছনে যথেষ্ট যুক্তিও আছে সাধারণ আফগানদের হাতে।
২০১৫ সালে তালেবান স্বীকার করেছিল যে সংগঠনটির প্রধান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের মৃত্যুর বিষয়টি দুই বছরের বেশি সময় ধরে গোপন রাখা হয়েছিল। তার মৃত্যুর পরেও তার নামে বিবৃতি প্রচার অব্যাহত রেখেছিল তালেবান।
এ অবস্থায় বারাদার কাবুলে ফিরবেন এবং দলীয় বিবাদের বিষয়টি প্রত্যাখ্যানে ক্যামেরার সামনেও দাঁড়াবেন বলে বিবিসিকে নিজেদের প্রত্যাশা জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র।
জল্পনা রয়েছে তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হায়বাতুল্লাহ আখুনজাদাকে নিয়েও। কখনো প্রকাশ্যে দেখা না যাওয়া এ নেতা তালেবানের রাজনৈতিক, সামরিক ও ধর্মবিষয়ক সামগ্রিক দায়িত্বে রয়েছেন।