বিকেলে বাড়ির উঠানে খেলছিল লাল মোহাম্মদের পাঁচ সন্তান। এ সময় হঠাৎ এক বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তাদের শরীর। নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে বড় জনের বয়স ছিল ১২ বছর, সবচেয়ে কমবয়সীর ছয়।
লাল মোহাম্মদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় মারা গেছে তার সন্তানেরা।
সন্তান হারানোর প্রতিশোধ নিতে তালেবানে যোগ দেন লাল। এক সময় আটকও হন তিনি। লালকে কাবুলের বাইরে বাগরাম বিমান ঘাঁটির জেলে রাখা হয়। সেখানে বন্দি থাকেন প্রায় ছয় বছর।
১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলের পর দেশটির বেশিরভাগ কারাগারের তালা ভেঙে ফেলে কট্টর ইসলামপন্থি গোষ্ঠী তালেবান। ওই সময় জেল থেকে মুক্ত হন লাল মোহাম্মদ।
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দি গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি তালেবান ছিলাম না। আমার পরিবারেরও কেউ তালেবান ছিল না। কিন্তু যখন আমার সন্তানদের হত্যা করা হলো, তখন তালেবানে যোগ দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।’
লাল মোহাম্মদ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র তাদের খুন করেছে। এর শোধ নেয়ার একমাত্র রাস্তা ছিল তালেবানে যোগ দেয়া।’
দীর্ঘ ২০ বছরের সামরিক আগ্রাসনের পর এ বছরের ৩১ আগস্ট আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার পর জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা ও তাদের আশ্রয় দেয়া তালেবান সরকারকে উৎখাত করতে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র।
শেষমেশ যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য করে সেই তালেবানই দেশটির ক্ষমতায় এসেছে।
আফগানিস্তানের পাঞ্জওয়াই জেলার একটি গ্রামে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন সেনা
যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পরই আফগানিস্তানের একের পর এক এলাকা দখল করতে শুরু করে তালেবান। প্রায় বিনা প্রতিরোধে ১৫ আগস্ট কাবুল দখল করে তারা। আফগান সেনাদের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের দুই দশকের বিপুল বিনিয়োগও তালেবানদের জয়যাত্রা ঠেকাতে পারেনি।
রোববার দি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, দুই দশকে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞই তালেবানের প্রতি জনসমর্থন বাড়িয়েছে। আর এতেই দেশজুড়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে তালেবান।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারিত্বের সময় অন্যতম কুখ্যাত হত্যাকাণ্ডটি ঘটে ২০১২ সালের ১১ মার্চে।
এদিন ভোরে একটি সেনাঘাঁটি থেকে কান্দাহারের পাঞ্জজাওয়াই জেলার জাংগাবাদ গ্রামে হাজির হন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা কর্মকর্তা রবার্ট ব্যালেস। সেখানে ঠান্ডা মাথায় ১৬ জনকে হত্যা করেন তিনি। এদের মধ্যে ছিল নয়টি শিশু।
অনেক আফগান টুইন টাওয়ারে হামলা সম্পর্কে জানত না। বেশির আফগানের সঙ্গেই জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদারও কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তবুও দীর্ঘ এক যুদ্ধের ভয়াবহতা তাদের গ্রাস করেছে।
২০১২ সালের ওই হত্যাকাণ্ডে পরিবারের প্রায় সবাইকেই হারিয়েছিলেন হাজি মোহাম্মদ ওয়াজির। ব্যালেস তার স্ত্রী, চার ছেলে, চার মেয়ে ও অন্য দুজন স্বজনকে হত্যা করেছিলেন। মাথায় গুলি করে হত্যার পর শিশুদের মরদেহ পুড়িয়ে দেয়ারও চেষ্টা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ওই সেনা কর্মকর্তা।
সংবাদমাধ্য়মটিতে দেয়া সাক্ষাৎকারে ওয়াজির বলেন, ‘এই আঘাত মেনে নেয়া আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল। আমার প্রায়ই মনে হয়, সেদিনের ওই হত্যাকাণ্ড যেন আজকেই ঘটছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি খুব খুশি যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গেছে। এটি হওয়ায় আমি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। অবশেষে নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছি।’
ওয়াজিরের পরিবারে চালানো হত্যাকাণ্ড দুই দশক ধরে চলা অগণিত হত্যাযজ্ঞের একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ মাত্র।
জাংগাবাদ গ্রামের পাঁচ জন জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর বাহিনীর বিমান হামলা ও হত্যাকাণ্ডে তারা ৪৯ জন স্বজন হারিয়েছেন।
ওয়াজির বলেন, ‘জীবিত সন্তানকে দেখাশোনার জন্য একমাত্র আমিই বেঁচে ছিলাম। এ কারণে নিজে যুদ্ধে যেতে পারিনি। তবে নানাভাবে তালেবানকে অর্থ সহযোগিতা করেছি।’
পাঞ্জওয়াই জেলার তালেবান কমান্ডার ফাইজানি মাওলায়ি সাহাব সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, ‘গণহত্যার কারণে অনেক মানুষ আমাদের দলে যোগ দিতে শুরু করে। এর আগে অনেক সমর্থন করলেও হত্যাযজ্ঞের পর তারা সরাসরি অস্ত্র হাতে নেয় অথবা অন্যভাবে সহযোগিতা করতে শুরু করে।’
২০০১ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল তালেবান। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা এই প্রস্তাব উপেক্ষা করে গোষ্ঠীটির নেতাদের হত্যা অব্যাহত রাখে।
ওই সময় একগুঁয়েমি না করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া হলে হয়তো দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও রক্তক্ষয় এড়ানো যেত।
আফগান অ্যানালিস্ট নেটওয়ার্কের সহপরিচালক কেইট ক্লার্ক বলেন, ‘তালেবানের এই উত্থান অনিবার্য ছিল না। ২০০১ সালেই শান্তির একটি বড় সুযোগ ছিল। তালেবানসহ সবাই মেনে নিয়েছিল, তারা পরাজিত হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের আফগান সহযোগীরা পরাজিতদের ধরে ধরে হত্যা শুরু করে। খুন হওয়াদের মধ্যে শুধু তালেবানই নয়, বিভিন্ন আঞ্চলিক নেতারাও ছিলেন।’
আফগান যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২ হাজার ৩০০ সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ২০ হাজার ৬০০ সেনা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র যুক্তরাজ্য হারিয়েছে প্রায় ৪৫০ সেনা।
তবে এ যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মূল্য চুকাতে হয়েছে আফগানিস্তানের জনগণকে। বিদেশি সেনা ও তালেবানসহ অন্য গোষ্ঠীগুলোর সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় আড়াই লাখ আফগান। এদের মধ্যে প্রায় ৭১ হাজারই বেসামরিক নাগরিক।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রের হামলাতেই নয়, তালেবানদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন বিপুল মানুষ। তালেবান যুদ্ধের ঢাল হিসেবে সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করেছে এমন ঘটনারও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ রয়েছে।