গ্রিক পুরাণে সময়ের দেবতা ক্রনোস গ্রাস করে নিয়েছিলেন নিজের সন্তানদের। তেমনই নিজ সৌরজগতের গ্রহকে গ্রাস করে ফেলে সূর্যের মতো বেশিরভাগ নক্ষত্র।
নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে, মহাবিশ্বে সূর্যের মতো যত নক্ষত্র আছে, সেগুলোর এক-তৃতীয়াংশই সম্ভবত তাদের ঘিরে থাকা এক বা একাধিক গ্রহকে ‘গিলে ফেলেছে’।
বিজ্ঞানবিষয়ক পোর্টাল সায়েন্সম্যাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন এ গবেষণার ফলে পৃথিবীর মতো গ্রহ নেই- এমন সৌরজগৎগুলোর কেন্দ্রীয় নক্ষত্র সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য জানা যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী এরিক মামাজেক বলেন, ‘সম্ভবত এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে যাচ্ছি আমরা।’
কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞানীরা ধারণা করে আসছেন যে অনেক সময় কিছু নক্ষত্র তাদের ঘিরে থাকা কক্ষপথের গ্রহকে গ্রাস করে ফেলতে পারে।
পাথুরে গ্রহ লোহা, সিলিকন আর টাইটানিয়ামের মতো ভারী উপাদানে সমৃদ্ধ। অন্যদিকে নক্ষত্র মূলত হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, অক্সিজেন আর কার্বনের মতো হালকা উপাদানে তৈরি।
যখন কোনো গ্রহকে কোনো নক্ষত্র গ্রাস করে বা ‘খেয়ে ফেলে’ বা ‘গিলে ফেলে’, তখন গ্রহটির ভারী উপাদানগুলো ওই নক্ষত্রের বাইরের আবরণে ছড়িয়ে যায়। এতে নক্ষত্রটি থেকে বিচ্ছুরিত আলোকছটায় পরিবর্তন আসে।
নতুন গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরি অফ পাডুয়ার জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী লরেঞ্জো স্পাইনা।
তিনি বলেন, ‘কোনো নক্ষত্রে লোহার মতো উপাদানের অস্বাভাবিক প্রাচুর্য থাকলে এবং কার্বন ও অক্সিজেনের মতো উপাদান কম থাকরে এটি ওই নক্ষত্রের ভেতরে কোনো না কোনো গ্রহের বিলীন হয়ে যাওয়ার বড় প্রমাণ।’
এ ধরনের ঘটনা কী অনুপাতে ঘটতে পারে, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন লরেঞ্জো স্পাইনা ও তার সহকর্মীরা। সূর্যের মতো দুটি নক্ষত্রের ১০৭টি ‘বাইনারি সিস্টেম’ পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা।
মাধ্যাকর্ষণের ফলে একটি সুনির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে দুটি মহাজাগতিক বস্তু একে অপরকে ঘিরে যে পদ্ধতিতে ঘুরতে থাকে, সেটি বিজ্ঞানের ভাষায় সৌরজগতের বাইনারি সিস্টেম।
বাইনারি নক্ষত্রও গ্যাসের মেঘ আর ধুলায় তৈরি। তাই তাদের রাসায়নিক মিশ্রণে থাকা প্রতিটি উপাদান প্রায় আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব।
৩৩টি দলে বিভক্ত এই বাইনারি সিস্টেমগুলোর মধ্যে একটিতে অন্যটির তুলনায় লোহা আর লিথিয়ামের পরিমাণ ছিল অস্বাভাবিক বেশি। এতে ওই নক্ষত্রে কোনো গ্রহ বিলীন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সূর্যের মতো নক্ষত্রগুলোতে জন্মের সময়েই প্রচুর পরিমাণ লিথিয়ামের উপস্থিতি থাকলেও প্রথম ১০ কোটি বছরেই তা পুড়ে যায়। তাই পুরোনো নক্ষত্রগুলোতে লিথিয়ামের উপস্থিতির অর্থ হলো- তা কোনো গ্রহ থেকেই নক্ষত্রে মিশেছে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, সবচেয়ে উত্তপ্ত নক্ষত্রগুলোতেও রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেশি থাকে।
এসব ফলের সমন্বয় ঘটিয়ে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, সূর্যের মতো ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ নক্ষত্রই তাদের ঘিরে থাকা অন্তত কয়েকটি করে গ্রহ গ্রাস করেছে।
এর কারণ হিসেবে বলা হয়, তীব্র মাধ্যাকর্ষণের কারণে মাঝে মাঝে গ্রহগুলো নক্ষত্রের ভীষণ কাছে চলে আসে। এরপর তীব্র তাপে বাষ্পে পরিণত হয়। এই অবস্থাটিকে বলা হচ্ছে নক্ষত্রের মধ্যে গ্রহের বিলীন হয়ে যাওয়া।
বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার অ্যাস্ট্রোনমিতে প্রকাশ করা হয়েছে মূল গবেষণা প্রতিবেদনটি।