আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের শত-কোটি ডলারের অস্ত্র ও অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম এখন তালেবানের হাতে।
আফগান সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়াতে সাঁজোয়া যান, ড্রোন, হেলিকপ্টার আর উড়োজাহাজসহ গত কয়েক বছরে ৩২ হাজার অস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এসবের কতটা তালেকানের হাতে পড়েছে, সেগুলোর ধরন- ইত্যাদি এখনও অস্পষ্ট। কিন্তু সশস্ত্র গোষ্ঠীটির অস্ত্রভাণ্ডার যে ব্যাপক সমৃদ্ধ হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
তালেবানের জব্দকৃত ১০টি অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের একটি তালিকা তৈরি করেছে টার্কিশ রেডিও অ্যান্ড টেলিভিশন (টিআরটি)। পত্রিকাটির এক বিশেষ প্রতিবেদনে যুদ্ধক্ষেত্রে এসব সামরিক সরঞ্জামের কাজও তুলে ধরা হয়েছে।
১. এ-২৯ সুপার টুক্যানো: হালকা ধাঁচের এই যুদ্ধবিমানের দাম দুই থেকে তিন কোটি ডলার। সমগোত্রীয় অন্য যুদ্ধবিমানের তুলনায় এটির দাম খানিকটা কম।
আমেরিকান প্রতিরক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান সিয়েরা নেভাদা করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, এ-২৯ সুপার টুক্যানো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বহরে সক্ষম। মূলত দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম এটি।
উড়ন্ত অবস্থায় ভূপৃষ্ঠের খুব কাছ থেকে এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি পরিদর্শনে এটি ব্যবহার করা যায়।
আফগানিস্তানের চতুর্থ বৃহৎ শহর মাজার-ই-শরিফের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমপক্ষে একটি এ-২৯ সুপার টুক্যানো জব্দ করেছে তালেবান।
২. ইউএইচ-৬০ ব্ল্যাক হক: সামরিক পরিবহন ও হামলা চালাতে ব্যবহৃত সাঁজোয়া হেলিকপ্টার এটি। বিশ্বের অন্যতম দামী এই হেলিকপ্টারের বাজারমূল্য ৫৯ লাখ ডলার।
এতে থাকা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পাইলট লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে পারে এবং রাইফেল ও লেজারচালিত ক্ষেপণাস্ত্রে হামলা চালাতে পারে।
দিন ও রাতের অভিযানে অনেক দূর থেকেও পাইলটের অবস্থান ও লক্ষ্যবস্তুর দূরত্ব সঠিকভাবে নির্ধারণে সক্ষম এটি।
১২ আগস্ট আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান, যেখানে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান সামরিক ঘাঁটি। ওই ঘাঁটি থেকে কমপক্ষে একটি ইউএইচ-৬০ ব্ল্যাক হক জব্দ করেছে তালেবান যোদ্ধারা।
৩. স্ক্যানইগল মিনি মিলিটারি ড্রোন: মানববিহীন ড্রোন (ইউএভি) এটি, যা ব্যবহার করা হয় বিশেষ অভিযানের সময় গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি ও পরিদর্শনের কাজে। গোপন তথ্যের সুরক্ষা, দ্রুততম সময়ে তারবিহীন অডিও ও ভিডিও প্রমাণ সংগ্রহেও এটি পারদর্শী।
২৪ ঘণ্টার বেশি সময় টানা পাখির দৃষ্টিতে ভিডিও ফুটেজ ধারণে সক্ষম এটি, তাও অনেক দ্রুতগতিতে। একেকটি স্ক্যানইগল মিনি মিলিটারি ড্রোনের দাম প্রায় ৩২ লাখ ডলার।
৪. এমডি-৫৩০এফ: এটি বহুমুখী সামরিক হেলিকপ্টার। একেকটির দাম ২৪ লাখ ডলারের বেশি। কৌশলগত ও পরিবহনের কাজে এটি ব্যবহার করা হয়।
রোটরক্রাফট মডেলের এই হেলিকপ্টার অন্যান্য রোটরক্রাফটের তুলনায় হালকা। গুলি করতে, অস্ত্র পৌঁছে দিতে এবং লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সহায়ক এটি।
তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো দ্রুত উড়তে পারার ক্ষমতা। তাই আক্রমণাত্মক অভিযানে এমডি-৫৩০এফের কৌশলগত কার্যকারিতা অনেক।
কমপক্ষে একটি এমডি-৫৩০এফ তালেবানের হাতে পড়েছে বলে জানা গেছে।
৫. মাইন-রেসিস্ট্যান্ট ভেহিকেলস (এমআরএপিস): ল্যান্ড মাইন, গুলি ও বোমা প্রতিরোধী সাঁজোয়া যান এটি।
এ ধরনের একেকটি গাড়ির মূল্য পাঁচ থেকে ১০ লাখ ডলার। সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলে নিরাপদ পরিবহন ও কর্মকর্তা ও আরোহীদের সড়কে পুঁতে রাখা বোমা থেকে বাঁচাতে এমআরপিস গাড়ি ব্যবহার করা হয়।
৬. এম১১৫১ হামভি: অস্ত্রবাহী অত্যাধুনিক সাঁজোয়া যান এম১১৫১ হামভি। একেকটির দাম প্রায় সোয়া দুই লাখ ডলার করে। বিশেষ অস্ত্র ও আরোহীদের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে নির্মিত হামভি অনেকটা লাইফগার্ডের মতো কাজ করে।
২০১৭ সালে আফগানিস্তানে চার হাজার ৭০০ হামভির একটি চালান পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যার প্রায় পুরোটাই এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে।
৭. এম২৪ স্নাইপার ওয়েপন সিস্টেম: এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা এটি, যার আওতায় বিভিন্ন সরঞ্জাম একটি অন্যটির সঙ্গে জুড়ে একটি ‘ইগল আই স্নাইপার রাইফেল’ তৈরি করা হয়।
ইগল আই স্নাইপার রাইফেল দিয়ে অনেক দূর থেকে লক্ষ্যবস্তুর দিকে নজর রেখে সঠিক সময়ে গুলি করা যায়।
৮: এম১৮ অ্যাসল্ট ওয়েপন: এম১৮ অ্যাসল্ট ওয়েপন হলো এক ধরনের সিঙ্গেল-শট রাইফেল, যার গুলি দিয়ে ট্যাঙ্কেও ফুটো করে দেয়া যায়।
ট্যাঙ্কবিধ্বংসী অস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী বুলেট ছুড়তে সক্ষম এই রাইফেল। এ ধরনের কয়েক হাজার রাইফেল জব্দ করেছে তালেবান।
৯. এম৪ কারবাইন: গ্যাস দিয়ে পরিচালিত এম৪ কারবাইন দিয়ে একসঙ্গে অনেক দিকে গুলি ছোড়া যায়। একেকটির দাম গড়ে ৭০০ ডলার করে। এতে লেজার, গ্রেনেড লঞ্চার, রাতের অন্ধকারে দেখার ব্যবস্থা, ফ্ল্যাশলাইট, লেজার মার্ক ও ছোট্ট একটি শটগান যুক্ত থাকে।
এমন কয়েক হাজার অস্ত্র আফগানিস্তানে ফেলে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, যা নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডারে যুক্ত করেছে তালেবান।
১০. ৪০ এমএম হাই এক্সপ্লোসিভ গ্রেনেড: স্বয়ংক্রিয় গ্রেনেড লঞ্চার হিসেবে তৈরি এই অস্ত্র দিয়ে দ্রুতগতির কার্তুজ ছোড়া যায়, যা দুই কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে সক্ষম।
স্বয়ংক্রিয় গ্রেনেড লঞ্চারের প্রতিটি কার্তুজের দাম ৪০০ থেকে ৫০০ ডলার।
গত ২০ বছরে আফগান সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের প্রায় পুরোটাই যুক্তরাষ্ট্রের কারিগরি সহযোগিতা ও সামরিক সরঞ্জামনির্ভর ছিল।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, শেষ কয়েক বছরেই আফগান সেনাবাহিনীকে সাত হাজারের বেশি মেশিন গান, ২০ হাজার গ্রেনেড, চার হাজার ৭০০ সাঁজোয়া যান, হেলিকপ্টার ও ছোট বিমানসহ দুই শতাধিক আকাশযান, ড্রোনের মতো সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এ সময়ে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে গড়ে তোলা ও প্রশিক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় ছিল আট হাজার ৩০০ কোটি ডলার।