২০ বছরের সামরিক উপস্থিতি শেষে আর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আফগানিস্তান থেকে পাততাড়ি গোটাতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মঙ্গলবারের মধ্যে নিজেদের সব সেনা সরিয়ে নিতে শেষ মুহূর্তে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে দেশটি।
সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আর ৩০০ নাগরিক আফগানিস্তান ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা আফগান-আমেরিকানদের অনেকে দেশটিতে থেকে যেতে পারেন।
১৪ আগস্টের পর প্রায় ছয় হাজার আমেরিকানকে আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি।
যাদের দমনের জন্য ২০০১ সালে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, সেই কট্টরপন্থি ধর্মীয় গোষ্ঠী তালেবান ইতিমধ্যে দেশটির রাজধানী কাবুল দখল করেছে। বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার গঠনের চেষ্টাও চালাচ্ছে গোষ্ঠীটি।
ভিনদেশি সেনাদের দেশ ছাড়ার খবরেও স্বস্তিতে নেই আফগানিস্তানের জনগণ। এর কারণ তালেবানের আগের শাসনামল নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা।
১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসেছিল তালেবান। এরপরই শরিয়া আইন কায়েমের নামে তারা দেশটির নারীদের ওপর নিপীড়ন চালাতে শুরু করে।
তালেবানের আগের শাসনামলে নারীদের জন্য বোরকা বাধ্যতামূলক করা হয়। শিক্ষা ও কাজের অধিকার থেকেও বঞ্চিত হন তারা। এমনকি সংবাদপত্রেও নারীদের ছবি ছাপানো নিষিদ্ধ করা হয়।
ইসলামবিরোধী এমন অভিযোগ তুলে গান-বাজনাও নিষিদ্ধ করেছিল কট্টর ইসলামপন্থি গোষ্ঠীটি।
এবার আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর আগেরবারের চেয়ে নিজেদের উদার দেখানোর চেষ্টা করছে তালেবান। গোষ্ঠীটি জানিয়েছে, শরিয়া আইনের ভেতরেই নারীর অধিকার রক্ষা করবে তারা। একই সঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার কথাও বলা হচ্ছে।
কাবুল দখলের পর সবার জন্য সাধারণ ক্ষমারও ঘোষণা দেয় গোষ্ঠীটি।
তালেবানের এমন অঙ্গীকারে আশ্বস্ত হচ্ছেন না আফগানরা। গোষ্ঠীটির কাবুল দখলের পরই বিমানবন্দরে ভিড় জমাতে শুরু করেন তারা। ইতিমধ্যে দেশ ছাড়তে মরিয়া আফগানদেরও সরিয়ে নিতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা।
যুদ্ধের শুরু যেভাবে
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা। একই সঙ্গে চারটি সমন্বিত হামলায় প্রাণ হারান প্রায় তিন হাজার মানুষ।
এ হামলার পরই আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে ওই বছরের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো। উৎখাত করা হয় ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয়া কট্টর ইসলামপন্থি গোষ্ঠী তালেবান সরকারকে।
মঙ্গলবার যখন যুক্তরাষ্ট্রের শেষ সেনাটিও আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাবে, সেই মুহূর্তে দেশটির ক্ষমতার দখল থাকছে তালেবানের হাতেই।
যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি
আগস্টের মাঝামাঝি আফগানিস্তান যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
এতে বলা হয়েছে, ২০০১ সালে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দুই হাজার ৩০০ সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ২০ হাজার ৬০০ সেনা।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র যুক্তরাজ্য হারিয়েছে প্রায় ৪৫০ সেনা।
১৫ আগস্ট কাবুলের প্রেসিডেন্ট প্যালেসের দখল নেয় তালেবান। ছবি: এএফপি
দীর্ঘস্থায়ী এ যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মূল্য চুকাতে হয়েছে আফগানিস্তানের জনগণকে। বিদেশি সেনা ও তালেবানসহ অন্য গোষ্ঠীগুলোর সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় আড়াই লাখ আফগান। এদের মধ্যে প্রায় ৭১ হাজারই বেসামরিক নাগরিক।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে প্রায় দুই ট্রিলিয়ন (দুই হাজার বিলিয়ন) ডলার।
শেষ মুহূর্তের পরিস্থিতি
১৫ আগস্ট কাবুল দখলের পর আফগানিস্তানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি ক্ষমতায় আসার পর দেশটি থেকে নিজেদের নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করে পশ্চিমাসহ বিভিন্ন দেশ।
কাবুল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্ধারকাজ করছিল যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। মিত্র দেশগুলোর সময় বাড়ানোর চাপ থাকলেও ৩১ আগস্টের মধ্যে উদ্ধারকাজ শেষ করার ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
আগে থেকেই বিমানবন্দরটিতে হামলার আশঙ্কা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সে জন্য আফগান ও নিজেদের নাগরিকদের সতর্কও করে। বৃহস্পতিবার সকালেও বিমানবন্দরে হামলা হতে পারে বলে সতর্ক করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। তাদের নাগরিকদের বিমানবন্দরে না আসার অনুরোধও করে।
বিমানবন্দর ও আশপাশের কিছু এলাকা থেকে আফগানদের সরিয়ে দিয়ে খালিও করা হয় এ দিন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। বৃহস্পতিবার বিকেলে বিমানবন্দরের বাইরে অ্যাবে গেটের পাশে এক বোমা হামলায় ১৭০ জন নিহত হন। এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ সেনাও ছিলেন।
জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-খোরাসান (আইএস-কে) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
সোমবার যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, এ দিন প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষকে আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে তারা। এ ছাড়া তালেবানের কাবুল দখলের পর প্রায় এক লাখ ২০ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
শেষ মুহূর্তে সোমবারেও কাবুল বিমানবন্দরে রকেট হামলা চালানোর কথা জানিয়েছে আইএস-কে। তবে এ হামলায় কেউ হতাহত হননি।
এর আগের দিন রোববারে আইএস-কে জঙ্গি সন্দেহে কাবুলের একটি লক্ষ্যবস্তুতে ড্রোন হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১০ বেসামরিক নাগরিক, যাদের ছয়জনই শিশু। স্বজনরা জানিয়েছেন, আফগানিস্তান ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ওই নিহতরা। তাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাও ছিল।
২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর ধারাবাহিকতায় আফগান সরকারকে এড়িয়ে তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি বিষয়ক আলোচনা শুরু করে দেশটি।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। এর বিনিময়ে বিদেশি সেনাদের ওপর হামলা বন্ধের অঙ্গীকার করে তালেবান। এ বছরের মে মাস থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এই সুযোগে আফগানিস্তানের একের পর এক অঞ্চল দখল করতে শুরু করে কট্টর ইসলামপন্থি গোষ্ঠীটি।
এপ্রিলের মাঝামাঝি আফগান যুদ্ধ অবসানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি জানান, ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব সেনা সরিয়ে নেয়া হবে।
তবে হঠাৎ করেই জুলাইয়ে সেনা প্রত্যাহারের তারিখ এগিয়ে এনে ৩১ আগস্ট ঘোষণা করেন বাইডেন।