বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘আমেরিকানদের মুখ দেখতে চাই না আর’

  •    
  • ২৮ আগস্ট, ২০২১ ১৩:০৯

যুক্তরাষ্ট্র উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা লঙ্ঘন করায় ক্ষুব্ধ শিরিন বলেন, ‘বিদেশিরা আমাদের ময়লার মতো ব্যবহার করেছে। তাদের সঙ্গে থাকার চেয়ে বরং নতুন তালেবান শাসকদের অধীনেই থাকব আমি। প্রত্যেক আফগানকে অপমান করেছে আমেরিকানরা।’

কাবুল বিমানবন্দরেই টানা পাঁচ দিন, পাঁচ রাত থেকেছেন আফগান শিক্ষিকা শিরিন তাবরিক। যখনই কোনো বিমান ছেড়েছে, প্রতিবার তাতে ওঠার চেষ্টায় ছিলেন মরিয়া। প্রতিবার চেষ্টা ভেস্তে গেছে।

রাগ, দুঃখ, অপমানে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে গ্রামে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিরিন। ফিরছেন তালেবানশাসিত নতুন ও অনাকাঙ্ক্ষিত এক জীবনে।

একই বিড়ম্বনার শিকার ধাত্রী শাগুফতা দস্তগীর। আফগানদের সাহায্য করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পশ্চিমা বিশ্ব, তাতে আস্থা হারিয়ে বাড়ি ফিরছেন তিনিও।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, তালেবানশাসিত আফগানিস্তান ছাড়তে চাওয়া অনেক মানুষ যে চরম বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে, তারই প্রতিফলন এসব গল্প।

লাখখানেক আফগান কাবুল বিমানবন্দর হয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে সক্ষম হয়েছে। বিপরীতে স্বপ্ন ভেঙেছে কয়েক লাখ মানুষের, যারা বিমানবন্দর থেকে ফিরে গেছেন তালেবানের অন্ধকার শাসনে।

ক্ষমতাচ্যুত আফগান সরকারের সাবেক এক কর্মকর্তার দ্বিতীয় স্ত্রী শিরিন। দুই স্ত্রীকে ফেলে স্বামী দেশ ছেড়ে পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছেন আরও ছয় মাস আগেই। প্রথম স্ত্রী আর তাদের তিন সন্তানের সঙ্গে এতদিন থাকছিলেন শিরিন; হয়েছেন বিদ্রুপের শিকার।

তালেবানশাসিত আফগানিস্তানে নিজের ভবিষ্যৎ জানা নেই ৪৩ বছর বয়সী এ নারীর।

সাধারণ আফগানদের শঙ্কা, পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থিত ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিল যারা, ২০ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে তাদের ওপর প্রতিশোধ নেবে তালেবান যোদ্ধারা।

সবচেয়ে আতঙ্কে নারীরা। মৃত্যুর চেয়েও তাদের বড় ভয় শোষণ আর বঞ্চনার জীবন। নব্বইয়ের দশকে প্রথম দফায় ক্ষমতায় থাকাকালীন শিক্ষা গ্রহণ, জীবিকা উপার্জনসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল তালেবান।

চলতি সপ্তাহে দ্বিতীয় দফায় দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে নারীর অধিকার রক্ষা ও তাদের নতুন সরকারে অংশ নিতে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিল তালেবান। শরিয়াহ আইন অনুযায়ী এসব সুযোগ দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়া হলেও এর অর্থ এখনও অস্পষ্ট।

তালেবান আশ্বাস কতটা রক্ষা করবে, তা নিয়ে সন্দিহান আফগান নারীরা।

এরই মধ্যে অনেক জায়গায় তালেবান যোদ্ধারা নারীদের জোরপূর্বক বিয়ে ও প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা লঙ্ঘন করায় ক্ষুব্ধ শিরিন বলেন, ‘বিদেশিরা আমাদের ময়লার মতো ব্যবহার করেছে। তাদের সঙ্গে থাকার চেয়ে বরং নতুন তালেবান শাসকদের অধীনেই থাকব আমি।

‘প্রত্যেক আফগানকে অপমান করেছে আমেরিকানরা। আমি ভালো পরিবারের মেয়ে। অথচ পাঁচটা রাত আমাকে খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় কাটাতে হয়েছে। মনে হচ্ছে যে, আমি ভিক্ষা করছি। তাও এমন কিছু লোকের কাছে ভিক্ষা চেয়েছি, যারা নারী-শিশুদের মানুষ বলেই মনে করে না।’

শিরিন জানান, তার কাছে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য বৈধ সব কাগজপত্র ছিল। কিন্তু বিমানবন্দরে বিদেশি নাগরিকদের জন্য এক রকম নিয়ম, আর আফগানদের জন্য আরেক নিয়ম।

তিনি বলেন, ‘বিদেশি একটা মানুষকে কোথাও থামানো হয়নি, তাদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকুক বা না থাকুক। আমার কাছে সব কাগজ থাকা সত্ত্বেও আমাকে কেন আমেরিকানরা আটকাচ্ছে? আমার পথ আটকানোর তারা কারা?’

দ্বৈত নাগরিকত্বধারী অনেক আফগানেরও পথ রোধ করা হচ্ছে বলে খবর মিলেছে। বিপরীতে পশ্চিমা নাগরিকদের বিমানবন্দরে পৌঁছাতে খুব একটা বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে না।

তবে যেসব আফগান দেশ ছাড়তে পেরেছেন, তারা বিদেশি সেনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাই জানিয়েছেন।

আফগানদের দেশে থেকে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তালেবান। গোষ্ঠীটি বলছে, দেশ চালাতে এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সাধারণ আফগানদের সহযোগিতা তাদের প্রয়োজন। আশ্বাসে কিছু সাবেক সরকারি কর্মী কাজে ফিরলেও বাকিরা আত্মগোপনে।

দেশ ছাড়ার আশা হারালেও হতাশ হতে রাজি নন শিরিন। দেশে থেকেই কিছু করতে চান তিনি।

শিরিন জানান, উত্তরাঞ্চলীয় ফারিয়াব প্রদেশে নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবেন।

তিনি বলেন, ‘হয়তো সেখানেই আমার জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। কিছু কৃষিজমি আছে। গম আর ফলফলাদি উৎপাদন করব সেখানে। একটা কুয়াও আছে। আর কিছু লাগবে না যতদিন বেঁচে আছি।

‘আমেরিকানরা চলে যাক, মরে যাক। আর কোনোদিন তাদের মুখ দেখতে চাই না এ দেশে।’

অন্যদিকে মাজার-ই-শরিফ প্রদেশের বাসিন্দা ছিলেন ২৯ বছর বয়সী শাগুফতা দস্তগীর। পেশায় প্রশিক্ষিত ধাত্রী শাগুফতা ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় দক্ষ। জার্মানিভিত্তিক একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থায় কাজ করার অভিজ্ঞতাও আছে তার।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সংস্থাটির কার্যালয় বন্ধ হয়ে গেলেও ছোট ছোট প্রকল্পে কাজ করছিলেন শাগুফতা। বেতনও পাচ্ছিলেন।

তিনি জানান, নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হলে ২০ জনের বেশি আফগান কর্মীকে জার্মানিতে পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়েছিল জার্মান দূতাবাস।

গত মাসে মাজার-ই-শরিফ দখলে তালেবানের সহিংস অভিযান শুরু হয়। তখন থেকেই দূতাবাস আর যে সাহায্য সংস্থায় কাজ করতেন, তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।

এরপর দেশ ছাড়ার আশায় বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে সোজা কাবুল বিমানবন্দরে পৌঁছান শাগুফতা। ভেবেছিলেন বিমানবন্দরে সহযোগিতা পেয়ে হয়তো দেশ ছাড়তে পারবেন।

তিনি বলেন, ‘পুরো রাস্তায় ঝুঁকি ছিল। কয়েক মাইল পরপরই তালেবান যোদ্ধারা আমাদের গাড়ি থামিয়েছে। আমরা বলেছি যে কাবুলে পরিবারের কাছে যাচ্ছি আমরা। তখন তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। নিজ বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছি বলে আমাদের বোকা, গাধা বলেছিল।’

শিরিনের মতো শাগুফতাও বিমানবন্দরে ঢুকতে পারেননি। চার দিন, তিন রাত অপেক্ষা করে বাড়িতে ফিরছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘মাজার-ই-শরিফেই ফিরে যাব। রাগ হচ্ছে না, বরং এখন ক্লান্ত বোধ করছি খুব। জার্মানদের খুব পছন্দ করতাম। এখন পশ্চিমাদের অন্য রূপ দেখলাম।’

জার্মান একটি কূটনীতিক সূত্র বলেছে, কাবুল বিমানবন্দরে নৈরাজ্যের কারণে গত কয়েক দিন ধরে বিমানবন্দরের প্রবেশপথে কার্যক্রম ছিল খুব সীমিত।

সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেয়ার পর কাবুল বিমানবন্দরে উদ্ধার অভিযানে ইতি টেনেছে বার্লিন। এসব মানুষের মধ্যে আফগান নাগরিক চার হাজার এক শর বেশি।

অথচ এর আগে স্থানীয় আফগান কর্মী, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীসহ ১০ হাজার মানুষকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল জার্মানি।

শাগুফতা বলেন, ‘বিমানবন্দরে মরিয়া মানুষের ভিড় দেখে আমার মনে হয়েছে যে আমরা পরিত্যক্ত। অথচ আল্লাহ জানেন, বিদেশিদের কোনো ক্ষতি সাধারণ বেসামরিক আফগানরা করেনি।’

এ বিভাগের আরো খবর