বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সামাজিকমাধ্যমে কোন কৌশলে এগোচ্ছে তালেবান

  •    
  • ২২ আগস্ট, ২০২১ ১৫:৪৬

জার্মান থিংকট্যাংক মার্শাল ডিজিটাল ফান্ডের সহকারী গবেষক অ্যাড্রিয়েন গোল্ডস্টেইন জানান, টুইটারে সক্রিয় কমপক্ষে ছয়জন তালেবান কর্মকর্তা। তাদের অনুসারী সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ। এ নেতাদের সাম্প্রতিক সব টুইটেই তালেবানকে দেখানো হয়েছে শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হিসেবে।

দুই দশকের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করা তালেবানের মধ্যে পরিবর্তন খুব সামান্যই দেখছে বিশ্ব। সেই সামান্য পরিবর্তনের একটি হলো আধুনিক যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নতুন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি।

এবিসি নিউজের একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলা হয়, একদিকে দেশের ভেতরে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আশ্রয় নিচ্ছে তালেবান, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের স্বীকৃতি পেতেও সামাজিক মাধ্যমকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে আফগানিস্তানের বর্তমান শাসক দল।

ক্ষমতা দখলের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন আনার দাবি করেছে তালেবান। নারী অধিকার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসহ নানা আশ্বাস দিয়েছে গোষ্ঠীটি, কিন্তু এসব আশ্বাস সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে বহির্বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্রনেতা।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শঙ্কা, তালেবানের শাসনামলে আবারও আল-কায়েদার মতো নিষিদ্ধঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর চারণক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে আফগানিস্তান।

মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ গোষ্ঠীটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়তা উদ্বেগজনক ও ভীতিকর।

কারণ এবার ক্ষমতায় এসে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে নিজেদের প্রতি ঢালাও সমর্থন দেখছে গোষ্ঠীটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বড় অংশ অনিয়ন্ত্রিত বলে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উগ্রবাদীদের আকৃষ্ট করা ও নিজেদের উগ্রবাদী আদর্শ আরও ছড়িয়ে দেয়া সহজ হবে তালেবানের জন্য।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণেই এবার বহির্বিশ্বের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে সক্ষম হয়ে উঠেছে তালেবান, যা আগে কঠিন ছিল। এভাবে দেশ ও দেশের বাইরে অনেক ঘটনাবলিও এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবাদ ও সংবাদমাধ্যমবিষয়ক জ্ঞানের অভাব আর অপপ্রচারকে পুঁজি করে জনসমর্থন নিজেদের দিকে টানতে তালেবান দীর্ঘদিন ধরেই বেশ কৌশলী। এভাবেই আফগান সরকারকেও অবস্থানগতভাবে দুর্বল করে তুলেছে গোষ্ঠীটি।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ছবি, ভিডিও আর বিবরণীতে কাবুলে চলমান নৈরাজ্যের চিত্র অস্পষ্ট। অথচ তালেবানশাসিত অঞ্চলগুলোতে গোষ্ঠীটি প্রচার করছে শহরের পরিস্থিতি ‘সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল, যা আগে ছিল না।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্মমতা আর নিপীড়ক নীতির জন্য সমালোচিত তালেবান সম্প্রতি ভাবমূর্তি তৈরির জন্য বিপরীতমুখী বার্তা দিচ্ছে অনলাইনে। তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চায়। তাই আফগানিস্তানের বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর পশ্চিমাদের ধোঁকা দেয়ার এ কৌশল নিয়েছে গোষ্ঠীটি।

ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক থিংকট্যাংক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অফ ডেমোক্রেসিসের সিনিয়র ফেলো টম জোসেলিন বলেন, ‘অনেক বছর ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে কৌশলী তালেবান…নিজেদের বার্তা পৌঁছে দিতে বেশ কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে গোষ্ঠীটি। বিভিন্ন ঘটনায় আফগান সরকার প্রতিক্রিয়া জানানোর আগেই তালেবানের বক্তব্য জানতে পারতাম আমরা।’

তিনি বলেন, ‘পশ্চিমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে তালেবান, এটাই মুখ্য বিষয়। তারা জানে কীভাবে সাংবাদিকদের নাচাতে হয়। তারা জানে কীভাবে কী বললে সে বক্তব্য পশ্চিমা দেশগুলোর কানে তা শ্রুতিমধুর শোনাবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয় গোষ্ঠীটি।’

বার্তার বন্যা তালেবানের

২০১৭ সালে সবশেষ প্রকাশিত তথ্যে বিশ্বব্যাংক জানায়, আফগানিস্তানে মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১১ দশমিক চার শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়। নব্বইয়ের দশকে তালেবানের আগের শাসনামলে এ হার ছিল শূন্য।

১৭ বছরের ব্যবধানে দেশটিতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠী তৈরি হলেও আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক থেকে ৪৯ শতাংশ পিছিয়ে ছিল আফগানরা।

অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শ্রোতা হিসেবে আফগানরা নয়, তালেবানের লক্ষ্য বহির্বিশ্ব।

অন্যদিকে তালেবানের স্থানীয় শ্রোতা, অর্থাৎ আফগান সমর্থকরাও দেশটির সংবাদমাধ্যম অবকাঠামোর ভগ্নদশার বলি। ক্ষমতাসীনদের মিথ্যা বিবৃতির ফাঁকফোকর ধরতে সেসব সংবাদমাধ্যম ব্যর্থ। সাধারণ আফগানদের জন্যও ঘটনার সত্যতা যাচাই করা কঠিন।

তার ওপর বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মতো আফগানিস্তানেও ইন্টারনেটবিষয়ক শিক্ষার হার সামান্য বলে মনে করেন গবেষকরা। ফলে সত্যের চেয়ে অপপ্রচারের বিস্তারই সেখানে বেশি।

জোসেলিন জানান, তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টুইটারে বেশ কয়েক বছর ধরেই ভীষণ সক্রিয়। গত সপ্তাহের আলোচিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছিলেন মুজাহিদ।

ইংরেজি, আরবি, পশতু ও উর্দুসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় তালেবান নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের বার্তা প্রচার করে থাকে।

জোসেলিন বলেন, ‘তালেবান প্রতিদিন যত ভাষায় বার্তা প্রকাশ করে, তত সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও করে না।’

অনলাইনে উগ্রবাদের প্রচার ঠেকাতে পদক্ষেপ নিয়েছে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ও দেশ। এতে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের সমর্থকদের ইন্টারনেটভিত্তিক কার্যক্রম সীমিত হয়ে এলেও তালেবান এখনও বাধাহীনভাবেই সামাজিক যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে।

তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তালেবান ইস্যুতে কোনো নির্দেশনাও পায়নি। তাদের তালেবানবিরোধী কোনো নীতিমালাও নেই।

এর ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গোষ্ঠীটিকে নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন।

অথচ বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ফেসবুক-টুইটারসহ বেশ কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিষিদ্ধ। এ নিয়ে গত কয়েক মাস ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর দ্বিমুখী নীতি নিয়ে সরব ট্রাম্পবিরোধীরা।

ফেসবুকের দাবি, প্রতিষ্ঠানটির ‘বিপজ্জনক সংগঠনবিষয়ক নীতি’র আওতায় কয়েক বছর ধরেই নিষিদ্ধ তালেবান।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির যুক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলাদা কালো তালিকায় তালেবানের নাম না থাকলেও সরকারের কিছু নিষেধাজ্ঞা আছে গোষ্ঠীটির ওপর। সে হিসেবেই ফেসবুকেও তারা নিষিদ্ধ।

তালেবান বা তালেবানের পক্ষে পরিচালিত অ্যাকাউন্টগুলো মুছে দেয়া হয়েছে বলে দাবি ফেসবুকের।

এ ধরনের অ্যাকাউন্ট শনাক্তে আরবি, পশতুসহ বিভিন্ন ভাষায় দক্ষ একটি বিশেষজ্ঞ দলও গঠন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

বিবৃতিতে ফেসবুক বলেছে, ‘কোনো দেশে স্বীকৃত সরকারের বিষয়ে ফেসবুক সিদ্ধান্ত নেয় না; বরং সে ক্ষেত্রে বিশ্ব সম্প্রদায়ের গৃহীত পদক্ষেপে শ্রদ্ধাশীল থাকাকেই বাঞ্ছনীয় বলে মনে করে। ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেন, সে হিসেবে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ও আমাদের নীতিমালা লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

এ বিষয়ে টুইটার এখনও কোনো অবস্থান ঘোষণা করেনি। আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে টুইটারে যাবতীয় তৎপরতা সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক আগেই ফেসবুক-টুইটারে তালেবানকে নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল।

জোসেলিন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তালেবানকে নিজস্ব একটি বাস্তুতন্ত্র গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। আত্মঘাতী হামলা থেকে শুরু করে নারীদের ওপর নিপীড়ন, কঠোর শরিয়াহ আইন প্রয়োগের বিষয়গুলোতে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছে তারা।’

যোগাযোগের সস্তা ও কার্যকর মাধ্যম

জার্মান থিংকট্যাংক মার্শাল ডিজিটাল ফান্ডের সহকারী গবেষক অ্যাড্রিয়েন গোল্ডস্টেইন জানান, টুইটারে সক্রিয় কমপক্ষে ছয়জন তালেবান কর্মকর্তা। তাদের অনুসারী সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ।

এ নেতাদের সাম্প্রতিক সব টুইটেই তালেবানকে দেখানো হয়েছে শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হিসেবে। গোষ্ঠীটির সংবাদ সম্মেলনেও এমন ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

তালেবানের টুইট অপপ্রচার আর মিথ্যায় ভরপুর বলে অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে মিডিয়া এশিয়া জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনেও এ ধারণাতেই সমর্থন দেয়া হয়।

বিশ্লেষকদের ভাষ্য, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও পরামর্শক সংস্থাগুলোর প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে ভিন্ন কিছুই প্রকাশ করে তালেবান; হোক তা সামাজিক বা অন্য কোনো মাধ্যমে।

২০১৮ সালে গবেষণাটি করার সময় কেউ ধারণাও করেনি যে তিন বছরের মাথায় আবারও আফগানিস্তান দখল করবে তালেবান। কিন্তু গোষ্ঠীটি সে সময় ঠিকই আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চেয়েও বেশি ও বিভিন্ন ভাষায় টুইটারে বার্তা প্রকাশ করত নিয়মিত।

একটি ঘটনা নিয়ে তালেবান ও সংবাদমাধ্যম আর বেসরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যের অসংগতি ছাড়াও গবেষণায় বেরিয়ে আসে সামাজিক মাধ্যমের ওপর তালেবানের নির্ভরশীলতার তথ্যও।

কারণ বিস্তৃত পরিসরে বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য এর চেয়ে সস্তা ও সহজ আর কোনো মাধ্যম নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের জন্য কোনো আধুনিক অবকাঠামো বা বিশেষজ্ঞেরও প্রয়োজন হয় না।

বিষয়টির সুযোগ নিয়ে ন্যূনতম অর্থ ও সময় ব্যয় করে আফগান সরকারের চেয়েও অনলাইনে বেশি প্রচার চালিয়েছে তালেবান।

অথচ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময় যেকোনোভাবে ইন্টারনেটের ব্যবহার নিষিদ্ধ রেখেছিল এ তালেবানই। নিষেধাজ্ঞা অমান্যে পেতে হতো কঠোর শাস্তি।

বিশ্লেষকদের মতে, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ক্রমেই পরিবর্তনীয়। টুইটার ব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ আফগানদের অনেকেই এখন দেশটির অবস্থা সম্পর্কে বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবহিত করে ও সাহায্য চায়।

এ বিভাগের আরো খবর