আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর চলতি সপ্তাহে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে আফিম, হেরোইন উৎপাদন ও পাচার বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেন তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ। এ আশ্বাসকে বাস্তবে রূপ দেয়ার সম্ভাবনা কতটা, সে হিসাব-নিকাশ করতে ব্যস্ত বিভিন্ন মহল।
আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করা সশস্ত্র গোষ্ঠীটির ইতিহাস কয়েক দশকের হলেও উত্থান শুরু মূলত নব্বইয়ের দশকে। শুরু থেকেই তাদের আয়ের প্রধান উৎস আফিম-হেরোইন। মাদক ব্যবসায় জড়িত স্থানীয় ও আঞ্চলিক বিভিন্ন অপরাধীচক্রের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বিক্রয়লব্ধ অর্থও পায় তালেবান।
ভাইস নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, জাবিহুল্লাহ মুজাহিদের এ প্রতিশ্রুতির আড়ালে একটা ‘কিন্তু’ আছে। কারণ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবে আফগানিস্তানের জন্য ‘আন্তর্জাতিক সহযোগিতা’ দরকার বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন তালেবান মুখপাত্র।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোটের হামলায় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও গত ২০ বছর ধরে বিদেশি সেনাদের অবস্থানের মধ্যেই একের পর এক হামলা চালিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়ে এসেছে তালেবান।
‘ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তান’ নামে স্বঘোষিত সমান্তরাল রাষ্ট্র কায়েম করেছে গোষ্ঠীটি। তাদের আছে নিজস্ব একটি সাদা পতাকাও।
দেশের ৩৪ প্রদেশে আছে তালেবানের ছায়া সরকার, যার বার্ষিক আয় প্রায় দেড় শ কোটি ডলার বলে জানা যায় তালেবান সদস্য ও জাতিসংঘের একটি কমিটির তথ্য থেকে।
আয়ের সিংহভাগেরই উৎস মাদক। কারণ সারা বিশ্বের হেরোইনের চাহিদার ৮০ শতাংশই উৎপাদন হয় আফগানিস্তানে। পাশাপাশি হাশিশ বলে পরিচিত বিশেষ ধরনের প্রক্রিয়াজাত গাঁজা আর মেথামফেটামিনধর্মী মাদকও উৎপাদন ও কেনাবেচা চলে তালেবানের তত্ত্বাবধানে।
হেরোইন উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রধান কাঁচামাল পপি গাছের ‘রেসিন’ বা রজন। আফগানিস্তানের আইনে নিষিদ্ধ হলেও সহজ চাষ আর লাভ বেশি বলে দুর্গম বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জীবিকা পপি চাষনির্ভর।
গত সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘আমাদের জনগণ ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করছি যে, আর মাদক উৎপাদন আমরা করব না। এখন থেকে কেউ মাদক চোরাচালানেও যুক্ত থাকবে না, হেরোইন কেনাবেচাতেও কারও সম্পৃক্ততা থাকবে না।’
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর কয়েক শ কোটি ডলারের আফিম আর হেরোইন বিক্রি হয়। স্থানীয় পর্যায়েই পপি চাষের বাজারমূল্য প্রায় ৩৫ কোটি ডলার। কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি কেজি পপি ৫৫ ডলার দরে কেনে হেরোইন উৎপাদকরা।
প্রক্রিয়াজাত পপি বিদেশে পাচারের পর এর বাজারমূল্য ১৪০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়।
তাই পপির ভূস্বর্গ আফগানিস্তানে কৃষকদের জন্য শস্যটি আশীর্বাদের শামিল। দেশটিতে বেশিরভাগ মানুষের বার্ষিক আয় ৬০০ ডলারের কম। পপি চাষ তাদের জন্য ক্ষুধামুক্তির প্রধান উপায়।
সহজে চাষযোগ্য পপি উৎপাদনে নিজেদের জমি ব্যবহার ছাড়া তেমন কোনো পুঁজিও দরকার হয় না।
আফগানিস্তানে পপি উৎপাদন ও উত্তোলনের পর প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে শুরু করে ইউরোপে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে এর দাম বাড়ে। ইউরোপে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দাম ছাড়িয়ে যায় আসলের ১০ গুণ। সব মিলিয়ে আফগান অর্থনীতির সব পর্যায়ে নগদ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে নিষিদ্ধ পপির ভূমিকা অপরিসীম।
অর্থনীতির এই চাপের কারণেই সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে এখন বাধ্য তালেবান। দ্বিতীয় দফায় আফগানিস্তানের নতুন শাসক দলটির পক্ষে চাইলেই মাদকের বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়া সম্ভব নয়। এটি সম্ভব করতে হলে আগে আফগান কৃষকদের আয়ের বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে গোষ্ঠীটিকে।
অভিজাত নিরাপত্তা বাহিনীর সাবেক এক ব্রিটিশ সেনা (যিনি বর্তমানে মাদকবিরোধী উপদেষ্টা) ভাইস নিউজকে বলেন, ‘মাদক উৎপাদন বন্ধের বিনিময়ে নিজেদের জন্য সেরা চুক্তিটি বের করে আনতে চাইবে তালেবান। দেখা যাক কী হয়। আলোচনায় তারা দারুণ।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা অবসর গ্রহণের আগে আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশে সফর করেছেন অসংখ্যবার। দেশটিতে হেরোইন উৎপাদনের অন্যতম প্রধান অঞ্চল এই হেলমান্দ।
তিনি বলেন, ‘তালেবান যে হেরোইন বাণিজ্যে মুগ্ধ, বিষয়টা তা নয়। ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীটির ধর্মীয় মতাদর্শ অনুযায়ী মাদক সেবন, কেনাবেচা সবকিছু সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
‘কিন্তু আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে পপি। তাই তালেবানও জানে যে বিকল্প ব্যবস্থা করা ছাড়া চাইলেই আয়ের এ উৎসে আঘাত হানার ক্ষমতা তাদের নেই।’
২০০৮ সাল থেকে বেশ কয়েকবার আফগান সরকারের মাদকবিরোধী কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা। আফগানিস্তানে বিদেশি ঠিকাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘মুজাহিদিনদের মুখে খাবার জুগিয়েছে হেরোইন। সোভিয়েত ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে তাদের অস্ত্রের জোগানও হয়েছে হেরোইন বিক্রির অর্থ থেকে। আবার গৃহযুদ্ধ শুরুর পর তালেবানবিরোধী আঞ্চলিক রণাঙ্গনের সব নেতা ও তাজিক-উজবেকসহ বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী আর্থিক ও অস্ত্রসাহায্য পেয়েছে হেরোইন বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে।’
সাবেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘নিজেদের লাভের জন্যই হেরোইন বাণিজ্যে কর বসিয়েছে তালেবান। বিশেষ করে ২০০৬ সালে যখন আমরা হেলমান্দে প্রবেশ করি, সে সময় তারা জানত যে আমাদের মাদকবিরোধী অভিযান কৃষকদের ক্ষুব্ধ করে তুলবে।
‘তাই তখন তারা বিদেশি দখলদারদের হাত থেকে আবাদি জমি বাঁচানো ও কৃষকদের স্বার্থরক্ষার নামে কর আরোপ করে। এভাবেই কৃষকদের কর্তৃপক্ষ বনে যায় তারা, যা এখনও বিদ্যমান।’
সেনা থেকে উপদেষ্টা বনে যাওয়া এই বিশ্লেষকের ভাষ্য, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে না পারা পর্যন্ত এসব বন্ধ করবে না তারা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া মাদক বাণিজ্য বন্ধের সক্ষমতা তাদের নেইও।
‘কারণ তখন পুরো দেশ না খেয়ে মরতে বসবে। হেরোইন তাদের একমাত্র টেকসই রপ্তানি পণ্য। তাই এটি বন্ধ করতে হলে দেশকে বাঁচিয়ে রাখতে তাৎক্ষণিক আলোচনায় বসতে তালেবান বাধ্য।’
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে টুইন টাওয়ারসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় একযোগে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সে বছরই আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো, যা চলে দীর্ঘ ২০ বছর।
সে সময় আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল তালেবান। আন্তর্জাতিক জোটের সেনা অভিযানে গোষ্ঠীটি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে দেশ শাসন করেছে প্রায় ছয় বছর।
প্রথম দফায় ক্ষমতায় থাকাকালীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মাদকবিরোধী সাহায্য হিসেবে কয়েক শ কোটি ডলারের বিনিময়ে হেরোইন রপ্তানি বন্ধে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল তালেবান।
সাবেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে আবার চুক্তিতে পৌঁছাতে পারলে স্থায়ীভাবে না হলেও কিছু সময়ের জন্য নিশ্চিতভাবে মাদক চোরাকারবার বন্ধ করবে তালেবান। কারণ ২০০০ সালেও গোষ্ঠীটি কম-বেশি নিজেদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে বলে আমরা দেখেছি।’
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানশাসিত অঞ্চলগুলো থেকে মাদকদ্রব্য রপ্তানি সত্যিই শূন্যের কোটায় নেমে এসেছিল। কিন্তু এর বিনিময়ে কৃষকদের আর্থিক সহায়তা বণ্টনের আগেই আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতিতে ধস নামে। দুর্ভিক্ষের যন্ত্রণায় সে সময় লাখো মানুষ প্রতিবেশী পাকিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
মাদকবিরোধী উপদেষ্টার মতে, এবারও চাইলে হেরোইন বাণিজ্য বন্ধ করতে পারবে তালেবান। কিন্তু তাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়।
শেষবার হেরোইন বাণিজ্য বন্ধের ফলে দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষাও হয়নি; বরং তাদের সামরিক হস্তক্ষেপে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘তাই এবার যদি পপি চাষ বন্ধ করতেই হয়, তাহলে নিজেদের জন্য সেরা চুক্তি চাইবে তালেবান।’