পুরো আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ এখন তালেবানের হাতে চলে গেলেও প্রাকৃতিক দুর্গ হিসেবে পরিচিত পঞ্জশির ভ্যালির দিকে যেতে কখনও সাহস দেখায়নি কট্টর ইসলামপন্থি গোষ্ঠীটি।
প্রাকৃতিকভাবে অপ্রতিরোধ্য এই ভ্যালি (উপত্যকা) থেকে তালেবান যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পঞ্চশিরে জন্ম নেয়া ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ।
প্রতিবেশী দেশ তাজিকিস্তানে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত জাহির আগবার বলেছেন, এই অপ্রতিরোধ্য প্রদেশ আমরুল্লাহ সালেহের নেতৃত্বে তালেবানের বিরুদ্ধে অজেয় দুর্গ হিসেবে কাজ করবে।
তাজিকিস্তানের রাজধানী দুসানবেতে আফগানিস্তানের দূতাবাসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে টাঙানো হয়েছে আমরুল্লাহ সালেহর ছবি।
গত রোববার তালেবান যোদ্ধাদের কাবুল অভিযানের সময় আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি পালিয়ে যান। এরপর একের পর এক শহর গোষ্ঠীটির নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে। ঠিক তারপর প্রথম প্রতিরোধের ডাক দিলেন এই আমরুল্লাহ সালেহ।
আফগানিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ। ছবি: সংগৃহীত
তবে পঞ্জশির থেকে এমন প্রতিরোধের ইতিহাস আরও বিস্তৃত।
হিন্দুকুশ পর্বতমালার মাঝে অবস্থিত এলাকাটি কখনও তালেবানের হাতে পড়েনি। কোন বিদেশি শক্তিও এর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি।
নব্বইয়ের দশকে দেশটির ক্ষমতার মসনদে বসা তালেবান যোদ্ধারা পঞ্চশিরের নিয়ন্ত্রণ নিতে পরেনি।
৯০ দশকে তালেবানের বিরুদ্ধে কাবুলের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় পঞ্জশিরে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন আহমেদ শাহ মাসুদ। তিনি পরিচিত ছিলেন ‘পঞ্জশিরের সিংহ’ নামে।
আফগানিস্তানের বীরযোদ্ধা আহমেদ শাহ মাসুদ (ডানে) ও তার ছেলে আহমেদ মাসুদ। ছবি: এএফপি
২০০১ সালে আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান আহমেদ শাহ মাসুদ।
তার ছেলে আহমেদ মাসুদ এবার ডাক দিয়েছেন তালেবানকে ঠেকানোর। তিনি তার মিলিশিয়া বাহিনীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র সহায়তাও চেয়েছেন।
আশির দশকেও তখনকার পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনারা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিলেও এই পঞ্জশিরে আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়।
আফগানিস্তানের এই দ্বিতীয় অপ্রতিরোধ্য উপত্যকার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে দ্য হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে।
উপত্যকাটি কাবুলের উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বতমালার মাঝে অবস্থিত। এই অজেয় ঘাঁটিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সরব ছিল অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদ।
নিজেকে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেয়া আমরুল্লাহ সালেহ জন্মেছেন এই পঞ্জশিরে। সেখান থেকে তিনি প্রশিক্ষণও পেয়েছিলেন।
এই অপরাজেয় দুর্গটি কখনও কোন বিদেশি শক্তি দখল করতে পারেনি। দেশীয় শক্তি তালেবানও এর দখল নিতে ব্যর্থ হয়েছিল।
পঞ্জশির ভ্যালি নামের অর্থ পাঁচ সিংহ। ১০ম শতাব্দিতে পাঁচ অজেয় ভাইয়ের বীরত্বের গল্পই হচ্ছে পাঁচ সিংহের জয়ের ইতিহাস। সে সময় তারা বন্যা নিয়ন্ত্রণে সুলতান মাহমুদ গজনবীর জন্যে নির্মাণ করেছিল ঐতিহাসিক বাঁধ।
কমপক্ষে ৫ লাখ বাসিন্দার বসবাস এই উপত্যকার অধিকাংশই নৃগোষ্ঠী তাজিক।
আহমেদ মাসুদ, আমরুল্লাহ সালেহ ও বিসমিল্লাহ খান মুহাম্মাদী এই পঞ্জশিরের প্রতিরোধ যোদ্ধা।
স্থানীয় সময় বুধবার ওয়াশিংটন পোস্টের মতামতে আহমেদ মাসুদ বলেন, ‘আমি আজ পঞ্চশির ভ্যালি থেকে লিখছি। আমার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে আমি প্রস্তুত। মুজাহিদীনরা তালেবানের ওপর ফের আঘাত হানতে তৎপর।’
তালেবান আফগানিস্তানের বড় অংশ গত কয়েক সপ্তাহে দখলে নিতে সমর্থ হলেও এখন পর্যন্ত পঞ্জশিরের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি।
সালেহ অজেয় পঞ্জশির থেকে বার্তা দিয়েছেন সোমবার। আর বুধবারই তালেবানবিরোধী বিক্ষোভ দেখা গেছে দেশটির জালালাবাদ শহরে।
এই শহরটিও যুদ্ধ ছাড়া তুলে দেয়া হয়েছিল তালেবানের হাতে। আর সেই শহরের বাসিন্দারাই সালেহর বার্তায় প্রতিরোধের অনুপ্রাণিত হয়ে তালেবানের তোলা পতাকা নামিয়ে নিজের দেশের পতাকা উড়িয়েছেন।
প্রতিরোধের এমন ঘটনা এই একটি নয়। বৃহস্পতিবার দেশটির স্বাধীনতা দিবসেও দেখা গেল একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
বৃহস্পতিবার জালালাবাদের আসাদাবাদ ছাড়াও বিক্ষোভ হয়েছে অন্তত ৫টি শহরে। বাদ যায়নি রাজধানী কাবুলও। এখানেও তালেবানের সরাসরি গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে তিন জন।
আফগানিস্তানের সরকারি ভবনগুলোতে তালেবানের পতাকা সরিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন বিক্ষুব্ধরা। ছবি: সংগৃহীত
প্রতিরোধের দাবানল সামাল দিতে খোস্ত প্রদেশে কারফিউ জারি করেছে সতর্ক তালেবান। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে এই কারফিউ দেয়া হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। সড়কে দেখা গেছে তালেবান সশস্ত্র যোদ্ধা ও তাদের সাঁজোয়া যানের সরব অবস্থান।
এর মধ্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও কার্যালয়ে দেশটির জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে বিক্ষুব্ধ জনতা।