২০ বছরের দখল শেষে আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। সেই সুযোগে ইতোমধ্যে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে কট্টর ইসলামপন্থি গোষ্ঠী তালেবান। রাজধানী কাবুলসহ আফগানিস্তানের সবকিছুই এখন তাদের দখলে।
এ ঘটনায় দুই দশক আগের তালেবান শাসনামলের স্মৃতি ফিরে আসছে আফগান নারীদের বয়ানে। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের শাসনামলে শরিয়াহ আইন কায়েমের নামে আফগান নারীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল তারা।
এবার মসনদে বসার আগে নিজেদের কিছুটা উদার দেখানোর চেষ্টা করছে তালেবান।
কাতারের রাজধানী দোহায় মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তালেবানের অন্যতম মুখপাত্র সুহাইল শাহিন জানান, ক্ষমতা দখলের পর এবার নারীদের বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করবে না তারা। তবে মাথা ঢাকতে পারে এমন হিজাব পরতে হবে।
কাবুলের রাস্তায় কয়েকজন তালেবান যোদ্ধা। ছবি: এএফপি
ওই সাক্ষাৎকারে সুহাইল আরও জানান, আফগান নারীরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষায় পর্যন্ত অংশ নিতে পারবেন।
নারী অধিকার প্রশ্নে তালেবানের এমন অবস্থান গোষ্ঠীটির ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন অনেকে। কেউ বলছেন মিথ্যা আশ্বাস।
মঙ্গলবারই কাবুলে আরেক সংবাদ সম্মেলনে গোষ্ঠীটির আরেক মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদিন দাবি করেছেন, ২০ বছরে অনেক বদলে গেছে তালেবান। আফগানিস্তানের নারীদের অধিকার নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তবে এটি শরিয়াহ আইন অনুযায়ী করা হবে বলেও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন জাবিহুল্লাহ।
শরিয়াহ আইনের আওতায় যেসব কঠোর শাস্তি রয়েছে
শরিয়াহ আইনে দুই ধরনের অপরাধের কথা বলা হয়েছে। এই আইনে গুরুতর অপরাধকে বলা হয় ‘হদ্দ’। এর জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে অপরাধ ‘তাজির’; এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি নির্ভর করে বিচারকদের রায়ের ওপর।
‘হদ্দ’ অপরাধের মধ্যে অন্যতম হলো চুরি ও বিবাহবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক। শরিয়াহ আইনে চুরির শাস্তি হিসেবে হাত কাটার বিধান রয়েছে। অন্যদিকে বিবাহবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্কের শাস্তি পাথর ছুড়ে হত্যা।
অনেক ইসলামি সংগঠন ও আলেমের দাবি, ‘হদ্দ’ অপরাধের শাস্তি দেয়ার আগে অনেক জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এ কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবে এই শাস্তি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
পাথর ছুড়ে হত্যার বিধানকে নির্মমতা ও অমানবিক হিসেবে অভিহিত করেছে জাতিসংঘ।
সব মুসলিম দেশে ‘হদ্দ’ অপরাধের জন্য এ ধরনের শাস্তির বিধান নেই। শরিয়াহ আইনে শাস্তি কার্যকর নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে মতভেদও রয়েছে।
শরিয়াহ আইনের প্রয়োগ যেভাবে
যেকোনো আইনি ব্যবস্থার মতো শরিয়াহ আইনও জটিল। এর জন্য প্রশিক্ষিত এবং উঁচু মানের ইসলামি বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়। ইসলামি বিচারকরা শরিয়াহ আইন-সম্পর্কিত বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এর ধরনের দিকনির্দেশনাকে ‘ফতোয়া’ বলা হয়।
শরিয়াহ আইনের পাঁচটি ঘরানা রয়েছে। সুন্নি মুসলমানদের এই ঘরানাগুলো হলো হানবালি, মালিকি, শাফেই এবং হানাফি। অন্যদিকে শিয়া মুসলমানদের একটিই ঘরানা- শিয়া জাফারি। শরিয়াহ আইনের প্রয়োগ কীভাবে হবে সেটি ঘরানার ওপর নির্ভর করে।
তালেবান যেভাবে শরিয়াহ আইন প্রয়োগ করেছিল
আগের শাসনামলে শরিয়াহ আইনের কঠোর প্রয়োগের কারণে তালেবান কুখ্যাত হয়ে রয়েছে।
১৯৯৬-২০০১ সালের শাসনামলে গোষ্ঠীটি আফগানিস্তানে প্রকাশ্যে পাথর ছুড়ে হত্যা, অঙ্গচ্ছেদ এবং ফাঁসি দেয়ার শাস্তি কার্যকর করেছিল।
সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি ক্ষমতা দখলের পর গান ও বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করেছিল। শুধু ‘দাফ’ নামে একধরনের বাদ্যযন্ত্রের অনুমোদন ছিল, যেটি প্রকাশ্যে হাত কাটা ও পাথর ছুড়ে হত্যার মতো শাস্তি কার্যকরের সময় বাজানো হতো।
শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের অজুহাতে তালেবানরা জীবন্ত কোনো কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে এমন চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করেছিল।
তালেবানের ওই শাসনামলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন আফগানিস্তানের নারীরা। ওই সময় আক্ষরিক অর্থেই তাদের গৃহবন্দি জীবন কাটাতে হতো। নারীদের কাজের বা শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না।
আগের শাসনামলে নারীদের বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করেছিল তালেবান। ছবি: এএফপি
আট বছর বয়স থেকেই কন্যাশিশুদের বোরকা পরতে হতো। ঘরের বাইরে যেতে হলে সঙ্গে থাকতে হতো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ কোনো পুরুষ সঙ্গী।
একতলা বাড়িগুলোর জানালা তক্তা মেরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে নারীরা ব্যালকনিতেও যেতে পারতেন না।
নারী প্রশ্নে গণমাধ্যমের ওপরেও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল তালেবান। সংবাদপত্রে বা ম্যাগাজিনে নারীদের ছবি ছাপানো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এ ছাড়া রেডিও, টেলিভিশন বা জনসমাগমে নারীদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
নারীদের যারা তালেবানের আইন অমান্য করতেন বা পুরুষ সঙ্গী ছাড়াই বাইরে আসতেন, তাদের রাস্তায় প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করত গোষ্ঠীটি।
তালেবানে ‘বিশ্বাস নেই’ আফগান নারীদের
মঙ্গলবার কাবুলের সংবাদ সম্মেলনে তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘আফগান নারীরা কোনো সহিংসতার শিকার হবেন না।’
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করে তিনি জানিয়েছেন, অধিকার ইস্যুতে নারীদের শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে বিশ্ব সম্প্রদায়গুলোকেও নারীর অধিকার নিশ্চিতে তালেবানের ‘প্রধান মূল্যবোধের’ প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।
মঙ্গলবার কাবুলের সংবাদ সম্মেলনে তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদিন।
এর আগে তালেবানের সাংস্কৃতিক কমিশনের সদস্য এনামুল্লাহ সামানগানি বলেছিলেন, ‘তালেবান নারীদের ভোগান্তির কারণ হতে চায় না। শরিয়াহ আইন অনুযায়ী তাদের সরকারকাঠামোয় থাকা উচিত।’
তালেবানের এমন সব প্রতিশ্রুতির পরেও আশ্বস্ত হতে পারছেন না আফগান নারীরা।
গোষ্ঠীটি কাবুল দখল নেয়ার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে খোলা চিঠি দিয়েছেন আফগানিস্তানের চলচ্চিত্র নির্মাতা সাহরা কারিমি। দেশটির নারীদের রক্ষা করার আকুতি ঝরেছে তার ওই চিঠিতে।
কারিমি চিঠিতে লিখেছেন, ‘তারা নারী অধিকার ছিনিয়ে নেবে। আমাদের নিজ ঘরে ছায়া হয়ে থাকতে হবে। আমার কণ্ঠস্বর, আমাদের প্রকাশভঙ্গিকে তারা চেপে ধরবে। তালেবান যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন স্কুলে কোনো মেয়ে ছিল না। তাদের যাওয়ার পর ৯০ লাখ আফগান মেয়ে এখন স্কুলে পড়ছে। এই কয়েক সপ্তাহে তারা অসংখ্য স্কুল ধ্বংস করে দিয়েছে ও ২০ লাখ শিশু স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।
আফগানিস্তানের চলচ্চিত্র নির্মাতা সাহরা কারিমি
‘নিজ দেশে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে আমি যে পরিশ্রম করেছি তার সবকিছুই এখন হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায়। তালেবানরা ক্ষমতায় এলে শিল্পকে নিষিদ্ধ করে দেবে। আমি ও অন্য নির্মাতারা তাদের হিটলিস্টে চলে আসব।’
নারীদের অধিকার নিশ্চিতের বিষয়ে তালেবানের প্রতিশ্রুতির দিনই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসে কলাম লিখেছেন নোবেলজয়ী পাকিস্তানি মানবাধিকারকর্মী মালালা ইউসুফজাই।
‘আই ফিয়ার ফর মাই আফগান সিস্টারস’ শিরোনামের কলামে তিনি লিখেছেন, ‘কিছু তালেবান বলছে তারা নারীদের শিক্ষা ও কাজের অধিকারকে খর্ব করবে না। তবে নারীদের ওপর তালেবানের নিপীড়নের ইতিহাস বলে, আফগান নারীদের ভয় পাওয়াটা কাল্পনিক কিছু নয়। আমরা ইতোমধ্যে এমন খবর শুনছি যে, নারী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দেয়া হচ্ছে না। অনেক নারীকে কাজে যোগ দিতে বাধা দেয়া হয়েছে।’
এখনও দেরি হয়ে যায়নি উল্লেখ করে আফগান নারীদের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন মালালা।