আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্টের জীবন ভীষণ কঠিন। ৭০ দশকের পর থেকে ক্ষমতায় থাকাকালে তিন জন হত্যার শিকার হয়েছেন। মেয়াদ শেষেও খুন হয়েছেন একজন। বেশ কয়েকজন মেয়াদ পূরণ না করেই দায়িত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তবে কোনো গণআন্দোলনে নয়, বেগতিক পরিস্থিতির কারণে।
আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৩ সালের পর থেকে আশরাফ ঘানি পর্যন্ত ১২ জন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় ছিলেন। এদের মধ্যে দুই জন দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তাদের একজন বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি, অন্যজন ১৯৯২ সালে আব্দুর রাহিম হাতিফ।
এই দুই জনই তালেবানের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে দেশ ছাড়েন।
আশরাফ ঘানি দুই দিন আগেও তালেবানকে প্রতিরোধের কথা বলেছেন। আশ্বস্ত করেছেন দেশবাসীকে যে, তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবেন।
কিন্তু রোববার তালেবান যোদ্ধারা রাজধানী কাবুলে ঢুকতে শুরু করলে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে তার সব প্রতিরোধ ব্যবস্থা। ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে তালেবানের সঙ্গে আলোচনা চলার মধ্যেই হঠাৎ বড় শিরোনাম হয়ে আসে তার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া।
হত্যার শিকার যারা
সর্দার মোহাম্মদ দাউদ খান ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৮ আফগানিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাদশাহ জহির শাহর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
সরকার পরিচালনায় দক্ষ হলেও, পররাষ্ট্রনীতিতে তার ছিল দুর্বলতা। আর এটাই কাল হয়েছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এই রাজনীতিককে। ১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল এক সেনা অভ্যুত্থানে হত্যা করা হয় তাকে।
কমিউনিস্ট নেতা নূর মোহাম্মদ তারাকি এরপর আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসেন। এক বছরের জন্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান তিনি। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে নিজ দলের একজনের হাতে প্রথমে বন্দী ও পরে তাকে হত্যা করা হয়।
মাত্র তিন মাস ক্ষমতায় টিকতে পেরেছিলেন বিপ্লবী পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সভাপতি হাফিজুল্লা আমিন। বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যার পর, তার নিজ দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তিনি একজন ষড়যন্ত্রকারী ও যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর ছিলেন।
১৯৭৯ সালে ২৭ ডিসেম্বর ক্ষয়তায় আসেন রুশপন্থী বাবরাক কামাল। এই সময় থেকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-সহ পশ্চিমি শক্তি মুজাহিদিনকে সবরকম সমর্থন টাকা পয়সা জোগানো, অস্ত্র সরবরাহ করা শুরু করে৷ পাকিস্তান, ইরান প্রভৃতি প্রতিবেশী দেশগুলিতে মুজাহিদিনরা ঘাঁটি গাঁড়ে এবং সোভিয়েতপন্থী সরকারের উপর হামলা চালাতে থাকে৷
১৯৮৬ সালের ২৪ নভেম্বর সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় এক বছরের জন্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন হাজী মোহাম্মদ চামখানি।
এর পর ক্ষমতায় আসেন আফগানিস্তানের সবচেয়ে আলোচিত নেতা মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ। পিপল ডেমোক্রেটিক এই নেতা সোভিয়েত আগ্রাসন কালে দখলদার বাহিনীর সহযোগী ছিলেন। তাকে কাবুলের কসাই নামেও ডাকা হতো।
মস্কোর সহায়তায় পর পর দুবার ক্ষমতায় ছিলেন এই নেতা। তবে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙে পড়ার দোড়গোড়ায় নাজিবুল্লাহকে ঘিরে ধরেন মুজাহিদিনরা। তালেবানদের কাবুল দখলের পর ১৯৯৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর নজিবউল্লাহকে গ্রেপ্তার করে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।’
নির্বাসনে
১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল কাবুলের ক্ষমতায় আসেন আব্দুর রাহিম হাতিফ। এরই মধ্যে দেশটিতে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসা তালেবানরা মাত্র ১২ দিনের মাথায় আব্দুর রাহিম হাতিফকে নির্বাসনে পাঠায়। ২০১৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসে ছিলেন তিনি।
অন্যরা
২৮ এপ্রিল ক্ষমতা আসেন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব আফগানিস্তান নেতা শিবঘাটউল্লাহ মুজাহেদ্দি। তালেবানের দাপটে ওই বছরের ২৮ জুনে ক্ষমতা ছাড়েন তিনি।
জামায়াত-ই ইসলামী নেতা বোরহানউদ্দিন রব্বানী ১৯৯২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন। মাত্র ১০ শতাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ছিল তার সরকারের।
৯০ দশকে তালেবানরা আফগানিস্তান দখল করে নেয়ার পর ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হামলার মুখে টিকতে না পেরে রাজধানী ছাড়ে তালেবানরা। তাদের সে সময়ের নেতা মোল্লা ওমরের পরিণতিও ভালো ছিল না। তাকে হত্যা করা হয়েছে, এমন দাবির কয়েক বছর পর তালেবান স্বীকার করে, তাদের নেতা আর নেই। তবে মৃত্যু যক্ষায় হয়েছে বলে দাবি করে গোষ্ঠীটি।
আন্তর্জাতিক বাহিনী আফগানিস্তানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলেন হামিদ কারজাই। অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২ বছরের দায়িত্বের পর ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আশরাফ ঘানির কাছে নির্বাচনে হেরে যান তিনি।
অর্থাৎ ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের পর বিদেশি সামরিক শক্তির বলে একজন প্রেসিডেন্টই বলতে গেলে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পেরেছেন।