আফগানিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবান দেশটির ৬৫ শতাংশ এলাকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বলে দাবি করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে মঙ্গলবার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন তিনি।
এক সপ্তাহেরও কম সময়ে ৩৪টি প্রাদেশিক রাজধানীর আটটি দখল করেছে তালেবান। আরও কমপক্ষে ১১টি প্রাদেশিক রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ হারানোর পথে আফগান নিরাপত্তা বাহিনী।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়, রাজধানী কাবুল থেকে খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার চেষ্টা করছে তালেবান।
সবশেষ মঙ্গলবার কাবুলের মাত্র ২০০ কিলোমিটার উত্তরে বাঘলান প্রদেশের রাজধানী পুল-ই-খুমরির দখল নেয় তালেবান। এর মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলীয় তিনটি প্রদেশের সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে গোষ্ঠীটি।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে জানানো হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে বড় পরিসরে, বিশেষ করে কৌশলগত দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাদেশিক রাজধানীগুলোর পতন ঠেকাতে চায় আফগান সরকার।
নগরাঞ্চলে তালেবানের অগ্রসর ঠেকাতে বিমান হামলা ও স্থল অভিযান চালাচ্ছে আফগান সেনাবাহিনী। সোম থেকে মঙ্গলবার ২৪ ঘণ্টায় ৩৬১ তালেবান সদস্যকে হত্যার দাবি করেছে তারা।
আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, নানগারহার, কুনার, লোগার, পাকতিয়া, পাকতিকা, মাইদান ওয়ারদাক, কান্দাহার, সার-ই-পুল, হেলমান্দ, কুন্দুজ ও বাঘলান প্রদেশে হয় এসব অভিযান।
বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের সুযোগে চলতি বছরের মে থেকে অব্যাহত অভিযানে আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে তালেবান।
তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতায় আনতে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো। কিন্তু আলোচনায় কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসেনি।
তালেবানের প্রাদেশিক রাজধানী দখলের সময় পরিক্রমা
১৪ এপ্রিল: গত বছরের শান্তিচুক্তিতে আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের উল্লেখিত তারিখ ১ মে থেকে পিছিয়ে ১১ সেপ্টেম্বরে নেয়ার ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ তালেবান দেশজুড়ে আগ্রাসন শুরু করে কিছুদিন পরই।
৪ মে: দক্ষিণের হেলমান্দ প্রদেশে আফগান বাহিনীর বিরুদ্ধে সে সময়ের সবচেয়ে বড় আগ্রাসী অভিযান শুরু করে তালেবান। আক্রমণ চালায় অন্তত আরও ছয়টি প্রদেশে।
১১ মে: রাজধানী কাবুল সংলগ্ন নারখ জেলা দখল করে তালেবান। দেশজুড়ে সহিংসতা তীব্র রূপ নেয়।
৭ জুন: আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৫০ জনের বেশি আফগান সেনা নিহতের খবর জানায় আফগান সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা। সে সময় নাগাদ দেশের ৩৪টি প্রদেশের ২৬টিতেই ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা।
২২ জুন: মূলত দক্ষিণাঞ্চলে আধিপত্য থাকলেও এ পর্যায়ে দেশের উত্তরাঞ্চলে ধারাবাহিক অভিযান শুরু করে তালেবান। জাতিসংঘের আফগানিস্তানবিষয়ক দূত জানান, দেশের অর্ধশতাধিক জেলা দখল করেছে গোষ্ঠীটি।
২ জুলাই: রাজধানী কাবুল থেকে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত বাগরাম বিমান ঘাঁটি গোপনে ছেড়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা। এর মধ্য দিয়েই আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের কার্যত সমাপ্তি ঘটে। গত ২০ বছর আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জোটের সেনা অভিযান পরিচালনার কেন্দ্র ছিল এটি।
৫ জুলাই: আগস্টের মধ্যে আফগান সরকারকে লিখিত শান্তি প্রস্তাব দিতে পারে বলে জানায় তালেবান।
২১ জুলাই: দেশের চার শতাধিক জেলার অর্ধেকের বেশি তালেবানের নিয়ন্ত্রণে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা।
২৬ জুলাই: বিমান হামলার মাধ্যমে তালেবানকে প্রতিরোধে আফগান সেনাদের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
মে ও জুনের সহিংসতায় রেকর্ড আড়াই হাজার আফগান বেসামরিক হতাহত হয়েছে বলে জানায় জাতিসংঘ। ২০০৯ সালের পর এক যুগে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ।
৬ আগস্ট: কয়েক বছরের মধ্যে দেশের প্রথম প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে দক্ষিণের জারাঞ্জ শহর দখল করে তালেবান।
৭ আগস্ট: দ্বিতীয় প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে উত্তরের জওজান প্রদেশের শেবারঘান শহর দখল করে গোষ্ঠীটি।
৮ আগস্ট: এক দিনে তিন প্রাদেশিক রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ হারায় আফগান বাহিনী। সার-ই-পুল, তালুকান ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কুন্দুজসহ তিনটি শহরই উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত।
৯ আগস্ট: উত্তরাঞ্চলীয় সামানগান প্রদেশের রাজধানী আইবাক থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয় আফগান সেনারা, পতাকা ওড়ায় তালেবান।
১০ আগস্ট: বাঘলান প্রদেশের পুল-ই-খুমরির নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান।
পশ্চিমের হেরাত আর দক্ষিণের কান্দাহারসহ বিভিন্ন শহরের দখল নিতে তালেবানের অব্যাহত আগ্রাসন চলছে। নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মরিয়া আফগান সেনারাও; চলছে রক্তক্ষয়ী সহিংসতা।