ভারতে করোনাভাইরাসে মৃত্যু সরকারি হিসাবে সোয়া চার লাখের কাছাকাছি। কিন্তু নতুন গবেষণায় বেরিয়ে ভিন্ন তথ্য।
এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির শুরু থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশটিতে করোনায় প্রাণহানির প্রকৃত সংখ্যা ৩৪ লাখের বেশি।
নতুন গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে টার্কিশ রেডিও অ্যান্ড টেলিভিশনের (টিআরটি) প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে করোনায় মৃত্যুহার সরকারি হিসাবের চেয়ে ১০ গুণ বেশি হতে পারে।
এতে উল্লেখ করা হয়, শঙ্কা বাস্তব হলে করোনায় বিশ্বের সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশ নিঃসন্দেহে ভারত। মহামারির প্রকৃত চিত্র নিয়ে সরকারের রাখঢাক ও গোপনীয়তা রক্ষার প্রবণতা আর ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থার ফলে দেশটির পরিস্থিতি ভয়াবহ।
সরকারি হিসাবেই করোনায় প্রাণহানিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের পরের অবস্থানে ভারত। সংক্রমণ শনাক্তের দিক থেকেও অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষে।
ভারতে এ পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছে তিন কোটি ১৬ লাখের বেশি মানুষের দেহে।
চলমান মহামারিতে মৃত্যু ও সংক্রমণে শীর্ষ দেশ যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় প্রাণ গেছে ছয় লাখ ৩০ হাজার মানুষের। সংক্রমিত তিন কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষ।
মহামারিকালে আগের বছরের তুলনায় অতিরিক্ত মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করেনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর বেশিরভাগই এ তথ্য প্রকাশ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের গবেষকরা করোনায় মৃত্যুর প্রকৃত চিত্র উদঘাটনে তথ্যের তিনটি উৎসের দ্বারস্থ হন। তথ্যের বিশদ বিশ্লেষণ করে তারা জানিয়েছেন, ভারতে সরকারি হিসাবের সঙ্গে প্রকৃত প্রাণহানির পার্থক্য ভয়াবহ।
প্রথম হিসাবেই গত মাস পর্যন্ত দেড় বছরে ভারতে করোনায় মৃত্যু সরকারি হিসাবের চেয়ে ৩০ লাখ বেশি।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিসাবে এ পার্থক্য আরও বেশি। এই দুই হিসাবে দেশটিতে করোনায় প্রাণহানি যথাক্রমে ৪০ লাখ ও ৪৯ লাখ; যা সরকারি তথ্যের প্রায় ১০ ও ১২ গুণ।
তবে এসব হিসাবেও কিছু ত্রুটি আছে বলে স্বীকার করেছেন গবেষকরা। শেষ পর্যন্ত করোনায় প্রাণহানির প্রকৃত সংখ্যা অজানাই থেকে যেতে পারে বলেও উদ্বেগ জানিয়েছেন তারা।
১৩৩ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে করোনায় মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা যে সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি, এ ধারণা দিন দিন জোরালো হচ্ছে নানা কারণে।
গত কয়েক মাসে বিহার, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশসহ ভারতের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্র বেশ কয়েকটি রাজ্য করোনায় মৃত্যুর সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করেছে।
এর আগে উত্তর প্রদেশে গঙ্গার তীরে হাজারো মানুষের কবর শনাক্তের ঘটনায় করোনায় তাদের মৃত্যু কি না, তা নিয়ে তোলপাড় হয় দেশজুড়ে।
অক্সিজেনের হাহাকার, হাসপাতালে শয্যা সংকটে চিকিৎসা ছাড়াই মানুষের মৃত্যুর কারণে মহামারির দ্বিতীয় ধাক্কাজুড়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে আলোচনার শীর্ষে ছিল ভারত।
কিন্তু গবেষকরা বলছেন, দেশটিতে মহামারির প্রথম ধাক্কা ছিল আরও বেশি প্রাণঘাতী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দ্বিতীয় ধাক্কার মতো মহামারির প্রথম ধাক্কা আকস্মিক ও একমুখী ছিল না; বরং প্রথম দফায় অনেক সময় নিয়ে ও বিস্তৃত পরিসরে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। সেটির স্থায়িত্বও দীর্ঘ ছিল।’
নতুন গবেষণার ফল সঠিক হলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর মহামারিতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি দেখছে ভারত।
ভারতে মহামারির প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি উদঘাটনে কয়েক মাস ধরে কাজ করছেন সংবাদকর্মী, শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীরা। করোনার ভয়াবহতার চিত্র দেশটির শ্মশান ও সমাধিক্ষেত্রগুলোতে জায়গা সংকটে স্পষ্ট।
উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা ও চিকিৎসায় অনেকের মধ্যে অনীহা; চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে ঋণে জর্জরিত হওয়ার ভয়ে গুরুতর অসুস্থ অনেকের হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে বাড়িতেই থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ভারতীয় চিকিৎসকদের বেশ কয়েকটি সংগঠন।
দ্রুত বিস্তারের ফলে করোনার রূপ পরিবর্তিত ও অতি সংক্রামক অসংখ্য ভ্যারিয়েন্ট দেশজুড়ে ছড়িয়েছে বলে চলতি বছরের মার্চে সরকারকে সতর্ক করে বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টাদের একটি ফোরাম। সে সতর্কবার্তা আমলে নেয়নি বলে সে সময় ভীষণ তোপের মুখেও পড়ে ভারত সরকার।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশের বেশি মানুষের দেহে করোনার অ্যান্টিবডির উপস্থিতি রয়েছে। এ হিসাবে দেশটিতে করোনায় আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যাও শনাক্তের তুলনায় অনেক অনেক বেশি।
ভারতে মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র সাত দশমিক তিন শতাংশ এ পর্যন্ত করোনা প্রতিরোধী টিকা নিয়েছেন।