আফগানিস্তানের পর ইরাকেও এ বছর সামরিক অভিযানে ইতি টানবে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকে দায়িত্বপ্রাপ্ত নিজ সেনাদের বছরের শেষ নাগাদ রণক্ষেত্র থেকে ফিরিয়ে নেবে ওয়াশিংটন।
ইরাকে অবস্থান করলেও কোনো ধরনের সেনা অভিযান বা যুদ্ধে অংশ নেবে না যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা।
হোয়াইট হাউসে সোমবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাষ্ট্র সফররত ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল-খাদিমি। তাদের বৈঠকের পরই আসে এ ঘোষণা।
বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে স্থানীয় যোদ্ধাদের সহযোগিতা দিতে বর্তমানে ইরাকে অবস্থান করছে আড়াই হাজার আমেরিকান সেনা। দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সামরিক অভিযান শেষ হওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রের মোতায়েনকৃত সেনার সংখ্যা প্রায় একই থাকবে।
তবে তাদের ভূমিকা দেশটির সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দানে সীমিত থাকবে বলে জানিয়েছেন বাইডেন।
তিনি বলেন, ‘ইরাকে আইএস জঙ্গিদের পুনরুত্থান ঠেকাতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখব আমরা। তবে এ বছরের শেষ থেকে সেখানে নতুন করে কোনো সেনা অভিযান বা সরাসরি যুদ্ধে আর অংশ নেব না।’
ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে বাইডেন প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তকে।
বৈঠকে খাদিমিকে বাইডেন বলেন, ‘আমাদের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক নতুন মাত্রা নিতে যাচ্ছে। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’
জবাবে খাদিমি বলেন, ‘বর্তমানে ইরাক ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। অর্থনীতি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অন্যান্য বিষয়ে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করে যাবে।’
এ সময় ইরাকে কোনো বিদেশি সেনার প্রয়োজন নেই বলেও জোর দেন তিনি।
গত বছর থেকে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি আঞ্চলিক রাজনীতিতে গুরুতর বিষয় হয়ে উঠেছে।
মূলত রাজধানী বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রতিবেশী ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলায়মানি গুপ্তহত্যায় নিহত হওয়ার পরই পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের ওই ড্রোন হামলায় সোলায়মানির সঙ্গে নিহত হন ইরান সমর্থিত এক শিয়া মুসলিম নেতাও।
এরপর থেকেই ইরাকে আইএসবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে অবস্থান করা যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোটের সব সেনা প্রত্যাহারের দাবি তোলে ইরানের প্রতি বিশ্বস্ত ইরাকি রাজনৈতিক দলগুলো।
যদিও এখনও দেশটির নিরাপত্তায় অব্যাহত হুমকি তৈরি করে যাচ্ছে সুন্নিপন্থি নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠনটি।
অন্যদিকে শিয়া যোদ্ধারাও ইরাকি সামরিক ঘাঁটিতে শত শত রকেট, বোমা ও ড্রোন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের।
আন্তর্জাতিক জোটের অবস্থান লক্ষ্য করে সম্প্রতি বেশ কিছু প্রাণঘাতী হামলা হয়েছে ঘাঁটিগুলোতে। বিদেশি সেনাদের ইরাক ছাড়তে চাপ প্রয়োগের লক্ষ্যেই চালানো হয় সেসব হামলা।
ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান শুরু হয়েছিল সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের শাসনামলে। ১৮ বছরের এ অভিযান সমাপ্ত হচ্ছে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট বাইডেনের হাত ধরে।
২০০৩ সালে ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দেশটিতে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। সাদ্দাম হোসেনের গণবিধ্বংসী অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংসের নামে ওই অভিযান শুরু হলেও পরে প্রমাণ হয় যে এমন অস্ত্রের কোনো অস্তিত্বই কখনো ছিল না। তার আগেই অবশ্য হত্যা করা হয় সাদ্দাম হোসেনকে।
যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়ের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ‘উদার ও শান্তিপূর্ণ ইরাক’ প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু উল্টো সাম্প্রদায়িক বিভাজনে রক্তক্ষয়ী অস্থিরতায় জর্জরিত হয়ে পড়ে দেশটি।
এরপর ২০১১ সালে ইরাকে একবার প্রত্যক্ষ সেনা অভিযানে ইতি টেনে দেশে ফেরে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা। কিন্তু জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস দেশটির বড় অংশ দখল করে স্বঘোষিত খেলাফত ঘোষণা করলে তিন বছর পর ইরাক সরকারের অনুরোধে আবারও সেখানে সামরিক অভিযান শুরু করে ওয়াশিংটন।
২০১৭ সালে ইরাকে আইএসের পতন ঘটলেও নতুন করে গোষ্ঠীটির মাথাচাড়া দেয়া রুখতে এখনও সেখানে থেকেই সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা।
বিদেশি ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম যুদ্ধক্ষেত্র আফগানিস্তানেও আমেরিকান সেনা অভিযান শেষ হতে যাচ্ছে চলতি বছর। এরই মধ্যে ৯০ শতাংশ সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম ফিরিয়ে নিয়েছে আন্তর্জাতিক জোট।