করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রাণহানির শিকার ব্রাজিল। দেশটিতে মহামারির তৃতীয় ধাক্কা আসন্ন। এতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, ভাইরাসের বিস্তার রোধে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব ও টিকা কার্যক্রমে ধীরগতির জন্য পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটছে দেশটিতে।
মহামারির প্রথম ও দ্বিতীয় ধাক্কার দুটিতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল ব্রাজিলে।
ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনে জানানো হয়, লাতিন আমেরিকার দেশটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর দৈনিক প্রাণহানি তিন হাজার ছাড়ায় ২০২০ সালের এপ্রিলে। মহামারির প্রথম ধাক্কার সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল সেটি।
এরপর মে-জুন মাসে দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যু ক্রমশ কমে এলেও জুলাই মাসে আবারও ঊর্ধ্বমুখী হয় সে গ্রাফ। সেবার মহামারির দ্বিতীয় ধাক্কায় দৈনিক প্রাণহানির গড় ছিল এক হাজার। এরপর আবারও এ সংখ্যা কমতে শুরু করে।
তৃতীয়বারের মতো গত এক সপ্তাহ ধরে আবারও ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ দেখছে ব্রাজিল। দেশটিতে দৈনিক গড় মৃত্যু ১ হাজার ৬০০।
দক্ষিণ গোলার্ধ্বের দেশটিতে শীত যখন আসি আসি করছে, সে সময়ে ফ্লু-ধর্মী ভাইরাসটিতে আবারও প্রাণহানিকে কঠিন সময়ের সংকেত হিসেবে দেখছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তাদের শঙ্কা, এবার সম্ভবত হাসপাতালের ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ রোগী, গণকবর, স্তূপের পর স্তূপ মরদেহ সংরক্ষণসহ আরও অনেক মর্মান্তিক দৃশ্যে চোখে অন্ধকার দেখবে ব্রাজিল।
মহামারির প্রায় দেড় বছরে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশটিতে করোনায় প্রাণ গেছে পৌনে ৫ লাখ মানুষের, যুক্তরাষ্ট্রের পর যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
এ ছাড়া ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ব্রাজিলের ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের দেহে। সংক্রমণের দিক থেকে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষে দেশটি।
ব্রাজিলে করোনায় প্রতি লাখে মৃত্যু হয়েছে ২২০ জনের। ২১ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশটিতে ভাইরাসরোধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কখনোই।
অন্যান্য দেশে লকডাউনের সময় ব্রাজিলে কিছু বিধিনিষেধ জারি হলেও অর্থনৈতিক দুর্দশায় দ্রুতই শিথিল হয় নিষেধাজ্ঞা।
এর মধ্যে টিকা কার্যক্রমের ধীরগতি আর ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘গামা’ সংক্রমিত হচ্ছে ব্রাজিলে। ভারতে প্রথম শনাক্ত ‘ডেল্টা’ ভ্যারিয়েন্টে উপস্থিতিও নিশ্চিত হয়েছে দেশটিতে।
সব মিলিয়ে রোগ সংক্রমণের গতি দ্রুতবেগে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন রোগতত্ত্ববিদরা।
এমন পরিস্থিতিতেও ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ নেই ব্রাজিলের কট্টর ডানপন্থি প্রেসিডেন্ট জায়ের বলসোনারোর। প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
সচেতন নন ব্রাজিলের জনসাধারণও।
ব্রাজিলের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ হোসে ডেভিড উরবাইজ বলেন, ‘ব্রাজিলের স্বাস্থ্য খাতে নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞই এখন নিত্য-নৈমিত্যিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ তো মহামারি বলে কিছু দেখছেই না, এমন ভান করছে।
‘এ কারণেই ব্রাজিলে মহামারির তৃতীয় ধাক্কা অবধারিত এবং খুব শিগগিরই তা দেখব আমরা।’
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অবশ্য নতুন করে সংক্রমণ ও প্রাণহানির ঊর্ধ্বমুখী চিত্রকে ‘তৃতীয় ধাক্কা’ বলতেই রাজি নন। কারণ প্রথম বা দ্বিতীয় ধাক্কাই প্রশমিত হয়নি ব্রাজিলে।
টিকা কার্যক্রম
চলতি বছরের মধ্যে ব্রাজিলের শতভাগ নাগরিককে টিকার আওতায় আনবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু তা সহজ হবে না বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যবিদরা।
এ পর্যন্ত ব্রাজিলের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশেরও কম মানুষ টিকা নিয়েছেন।
এ অবস্থায় টিকা কার্যক্রম গতি পেলে মহামারি তত্ত্বের নিয়ম মেনেই উন্নতির দিকে যাওয়ার আগে পরিস্থিতির চরম অবনতির শঙ্কা আছে।
ইউনিভার্সিটি অফ ব্রাসিলিয়ার মহামারি রোগ বিশেষজ্ঞ মাউরো সানচেজ বলেন, ‘সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধ শিথিলের ফলে ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে।
‘সংক্রমণের হারের বিপরীতে টিকা কার্যক্রমের গতি যদি ধীর হয়, তাহলে ব্রাজিলের ওপর মহামারির তৃতীয় আঘাত অকল্পনীয় হবে।’
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাও পাওলো প্রদেশের সেরেনা শহরে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৯৫ শতাংশই টিকা নিয়েছেন।
এর ফলে ৪৫ হাজার জনগোষ্ঠীর শহরটিতে করোনায় মৃত্যুহার কমেছে ৯৫ শতাংশ; হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার কমেছে ৮৬ শতাংশ।