খ্রিষ্টানদের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিসের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন জার্মান কার্ডিনাল রেইনহার্ড মার্কস। মিউনিখ এবং ফ্রেইজিংয়ের আর্চবিশপের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন রেইনহার্ড মার্কস।
তিনি বলেন, “ক্যাথলিক চার্চ একটি ‘ডেড পয়েন্ট’-এ পৌঁছেছে। আমি আশা করি, এমন পদত্যাগ থেকে নতুন কোনো পরিবর্তনের যাত্রা শুরু হতে পারে।’’
এই শীর্ষ পাদ্রি আরও বলেন, ‘সবশেষে আমি বলতে চাই, গত কয়েক দশক ধরে গির্জার কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় যে ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে, আমি তার দায় এড়াতে পারি না। তাই পদ থেকে সরে গিয়ে আমিও এর দায়ভার কাদে তুলে নিলাম।’
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভ্যালেতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কস তার এমন সিদ্ধান্তের পেছনের কারণগুলো ব্যাখ্যা করে পোপকে জানিয়েছেন।
মার্কস জানান, এ বিষয়ে গত দশ বছরের তদন্ত প্রতিবেদনগুলোতে উঠে এসেছে
ক্যাথলিক চার্চের এমন ভয়াবহ পরিণতির পেছনে ব্যক্তিগত পর্যায়ের ব্যর্থতা এবং প্রশাসনিক ত্রুটি ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক এবং কাঠামোগত ব্যর্থতাও দায়ী।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন আলোচনায় উঠে এসেছে, যৌন-নিপীড়নের ঘটনায় গির্জার কেউ কেউ এর দায়ভার স্বীকার করতে চায় না এবং ক্ষমতার অপব্যবহার-সম্পর্কিত যেকোনও সংস্কার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন তারা।
গত ২১ মে পোপ ফ্রান্সিসকে পাঠানো এই চিঠিটি শুক্রবার মিউনিখে তার আর্চডিয়োসিসের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
এই বিষয়ে আর্চডিয়োসিস তার বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, পোপ ফ্রান্সিস তখন থেকেই কার্ডিনাল মার্কসের চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। পোপ জানান যে তিনি এই চিঠিটি প্রকাশ করবেন এবং তার কাছে থেকে উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত মার্কস যেন তার দায়িত্ব থেকে ইস্তফা না নেন।
ব্যক্তিপর্যায়ে দায়ভার নিতে প্রস্তুত
মার্কস জানিয়েছিলেন যে, কয়েক মাস ধরে তিনি পদ থেকে সরে যেতে বারবার চিন্তা করেছিলেন।
তিনি জানান, গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ এবং আলোচনাগুলো তার পদত্যাগের পেছনে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। তবে তিনি জোরালোভাবে জানান তার পদত্যাগের সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে ব্যক্তিগত কারণে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমি কেবল নিজের ভুলের জন্য নয়, একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গির্জার পক্ষে দায়ভার নিতে প্রস্তুত। কারণ আমি কয়েক যুগ ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলতে সহায়তা করেছি।’
সংস্কারের পক্ষে আইনি পদক্ষেপ
এর আগে গির্জায় যৌন নিপীড়নের শিকার ভুক্তভোগীদের কাছে ক্যাথলিক চার্চের পক্ষে ক্ষমা চেয়েছিলেন মার্কস।
মার্কস ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জার্মান বিশপস সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন।
মার্কসের নেতৃত্বে জার্মান বিশপস কনফারেন্সের গঠিত কমিশনের ২০১৮ সালের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৪৬ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ১৬৭০ ধর্মযাজক যৌন আক্রমণ চালিয়েছে ৩৬৭৭ জন শিশুর ওপর, যাদের বেশির ভাগই ছেলেশিশু।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, যে ভুক্তভোগীদের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
জার্মানের গির্জায় যৌন নির্যাতনের বিষয়ে পোপের তদন্তের নির্দেশ
মে মাসে কোলনে শহরের ডায়োসিসে শিশু যৌন নির্যাতনের ওপর ‘সম্ভাব্য ভুল’ এড়িয়ে অধিকতর গ্রহণযোগ্য তদন্ত প্রতিবেদন করতে দুজন প্রতিনিধিকে পাঠিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস।
১৯৭৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ১৪ বছরের কম বয়সী অন্তত তিন শতাধিক শিশু নিপীড়নের ঘটনা তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসার পরে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানান পোপ। এর মধ্যে দুই শতাধিক শিশুকে শারীরিকভাবে আহত করা হয়েছিল।
মার্চে জমা দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তত ৭৫টি নির্যাতনের ঘটনায় গির্জা কর্তৃপক্ষ নিপীড়ন রোধে তাদের দায়িত্বে অবহেলা করেছেন।
গির্জার পুরোহিতদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের এমন বিস্তারিত বিবরণ প্রতিবেদন উঠে আসার পরেও তা প্রকাশ না করায় সমালোচিত হয়েছিল কোলনের কার্ডিনাল রেনার মারিয়া ওলকি।
এ সময় তিনি দাবি করেন, বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করতে বাধা হিসেবে কাজ করেছে।
চলতি মাসে কোলনে যাচ্ছেন এমন দুই পরিদর্শকের মধ্যে রয়েছেন স্টকহোম অ্যান্ডার্সের কার্ডিনাল আরবোরেলিয়াস এবং রটারড্যাম জোহানেসের বিশপ ভ্যান ডের হেন্ডে।
একের পর এক এমন কেলেঙ্কারির ঘটনায় জার্মানির সবচেয়ে বড় ডায়োসিস ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন গির্জার হাজারো সদস্য।
কলোনের ক্যাথলিক চার্চ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ডায়োসিস ভ্যাটিকানের চেয়ে বেশি আয় করে।
২০১৯ সালে জার্মানির এই ক্যাথলিক চার্চের সদস্য সংখ্যা ছিল ২ কোটি ২৬ লাখ। আর এটি ছিল দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।