দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু তিন লাখ ছাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পর করোনায় বিশ্বে ব্রাজিলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হলো।
এক বছরে ব্রাজিলের সোয়া কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ শুরু হওয়ায় আবারও বাড়ছে সংক্রমণ, মৃত্যু। ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ব্রাজিলের সব হাসপাতাল। গুরুতর অসুস্থ হয়েও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) শয্যা মিলছেনা লাখো মানুষের।
মহামারির এই ভয়াল চিত্রের মাঝে ২১ মার্চ নিজের ৬৬তম জন্মদিন উদযাপন করেছেন প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো। উৎসবমুখর পরিবেশে হাজারো সমর্থকের সঙ্গে হাসিমুখে তার সাক্ষাতের দৃশ্যই বলে দেয়, মৃতের সারি দীর্ঘতর হতে থাকলেও এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই রাষ্ট্রপ্রধানের।
বুধবার সন্ধ্যায় ব্রাজিলে করোনায় প্রাণহানি তিন লাখের ঘর ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন মাত্রা পেয়েছে বোলসোনারোবিরোধী সমালোচনা।
বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, শুরু থেকে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করা প্রেসিডেন্টের মিত্ররাও এখন অসহায়। করোনায় সারা বিশ্বে প্রতিদিন যে প্রাণহানি হচ্ছে, তার এক-তৃতীয়াংশই ব্রাজিলে। এ অবস্থায় মহামারি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গৃহীত কৌশল ও ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার পরামর্শ বোলসোনারোর ঘনিষ্ঠদেরও।
যদিও এতেও দমতে নারাজ প্রেসিডেন্ট। ছোঁয়াচে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে মানুষের চলাফেরায় কড়াকড়ি আরোপে মত নেই তার। এখনও তিনি নানারকম ঘরোয়া ও টোটকা চিকিৎসা নেয়ার কথা বলছেন।
সোমবার প্রেসিডেনসিয়াল প্যালেসে এক অনুষ্ঠানে সমালোচকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ুন, প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নয়।’
নজিরবিহীন মহামারি পরিস্থিতিতে ব্রাজিলে প্রায় সব হাসপাতালেই স্বাস্থ্যসেবা ধসে পড়ার মুখে, পর্যাপ্ত জোগান নেই ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামের।
এ অবস্থায় বুধবার কংগ্রেসে বোলসোনারোর দলেরই এক আইনপ্রণেতা আর্থার লিরা বলেন, ‘প্রেসিডেন্টের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু সবকিছুর একটা সীমা থাকে। যাদের প্রতিনিধি হয়ে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে আছি, তারাই আমাদের প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছেন।’
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে থাকা বিরোধীদলীয় সিনেটর আলেসান্দ্রো ভিয়েইরা জানান, যেকোনো সময় পার্লামেন্ট থেকে এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুর পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে। হয়তো আগামী মাসেই।’
এতে ২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বোলসোনারোর জনপ্রিয়তায় বড় আঘাত আসতে পারে।
অবশ্য এক বছর আগে করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে ‘সামান্য সর্দিজ্বর’ আখ্যা দেয়া বোলসোনারো বর্তমান পরিস্থিতিকে কিছুটা গুরুত্ব দিতে রাজি হয়েছেন। একদিনে রেকর্ড সংক্রমণের তথ্য প্রকাশের পর মঙ্গলবার রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘রূপ বিবর্তনের কারণে ভাইরাসটি দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৫০ কোটি ডোজ টিকা কিনতে যাচ্ছে সরকার। ২০২১ সাল হবে ব্রাজিলের টিকাবর্ষ।’
তার এ ভাষণের পরপরই রাজধানী ব্রাসিলিয়াসহ বড় সব শহরে নিজ নিজ বাড়ি থেকে থালা-বাসনে আওয়াজ তুলে প্রতিবাদ জানান বিপুলসংখ্যক মানুষ।
একই দিন দায়িত্ব নেন ব্রাজিলের নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। মহামারির এক বছরে দেশটিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বদলেছে চার বার।
মহামারি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বুধবার প্রথম, কেন্দ্রীয় সরকারের সব শাখার প্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বোলসোনারো। কিন্তু করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে কোনো নীতি উপস্থাপন করেননি তিনি। বরং কোভিড নাইনটিনের চিকিৎসায় ম্যালেরিয়ার ওষুধ ব্যবহারের সাফল্য প্রমাণিত না হলেও আবারও এ ওষুধ ব্যবহারের কথাই বলেন।
রাজ্যে রাজ্যে আইসিইউ বেড, অক্সিজেন, গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের সংকট নিয়েও কোনো কথা বলেননি বোলসোনারো।
বুধবারের বৈঠকে উপস্থিত এক গভর্নর আলাগোয়াস রেনান ফিলহো বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট হয়তো সত্যিই কোনো পদক্ষেপ নিতে চান। কিন্তু তিনি নিজেই আত্মবিশ্বাসী নন। জাতীয় পর্যায়ে কোনো কৌশল গ্রহণের ইচ্ছা তার থাকলেও যিনি নিজের উদ্দেশ্য নিয়েই নিশ্চিত নন, তার পক্ষে এ কাজ করা কঠিন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মহামারি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থ প্রেসিডেন্ট ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর এখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে রয়েছেন। গত সপ্তাহে ডাটাফোলহার এক জরিপে উঠে আসে, প্রেসিডেন্টের প্রতি অসন্তুষ্ট দেশটির ৫৪ শতাংশ মানুষ।