বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ব্রিটিশ রাজে বর্ণবাদের দেড় শ বছর!

  •    
  • ২১ মার্চ, ২০২১ ২১:৫৮

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দাদার দাদি ভিক্টোরিয়ার ১৮৬০’র দশকে বিশ্বের নানা প্রান্তের ভিন্ন বর্ণের মানুষকে ‘গডচিলড্রেন’ বা ‘ধর্মসন্তান’ হিসেবে দত্তক নেন। মেগানের ভাগ্যকে তাদের সঙ্গেই মেলাচ্ছেন ইতিহাসবিদরা।

ব্রিটিশ সিংহাসনের ষষ্ঠ উত্তরাধিকারী প্রিন্স হ্যারিকে বিয়ে করার সুবাদে রাজপরিবারের সদস্য হয়েছেন আফ্রো-আমেরিকান বংশোদ্ভূত সাবেক হলিউড অভিনেত্রী মেগান মার্কেল। তিনি প্রথম নন; তার আগেও শ্বেতাঙ্গ রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়েছে ভিন্ন বর্ণের আরো অনেকে।

অবশ্য মেগানের মতো নাম-যশ-খ্যাতি আর কারও ছিল না।

রাজপরিবারে পা রাখার আগেই নিজ পরিচয় ও যোগ্যতায় শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিলেন সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া মেগান। হলিউড অভিনেত্রী হিসেবে নাম ছড়ানো শুরু হয় তার; কাজ করেছেন সমাজকল্যাণ আর নারী অধিকার কর্মী হিসেবেও।

ব্রিটিশ রাজপরিবারের বধূ হতে নিয়ম মেনে অভিনয় ছাড়লেও এখনও নিয়মিত সংবাদ শিরোনাম দেখা যায় মেগানের নাম। স্বামী ডিউক অফ সাসেক্স প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে প্রখ্যাত আমেরিকান উপস্থাপক অপরাহ উইনফ্রের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সবশেষ আলোচনায় আসেন ডাচেস অফ সাসেক্স মেগান।

২০১৮ সালে বিয়ের পর থেকে রাজপরিবারে এবং সংবাধমাধ্যমে কীভাবে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়েছেন, অনুষ্ঠানে সেটাই তুলে ধরেন হ্যারি-মেগান দম্পতি।

আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসাসহ রাজপরিবারের সঙ্গে থাকাকালীন নানা অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন মেগান।

তিনি বলেছেন, ‘রাজপরিবারের সদস্য হলাম যেদিন, তারপর থেকে রাজপরিবারকে বিদায় জানিয়ে যুক্তরাজ্য ছাড়ার আগ পর্যন্ত নিজের পাসপোর্ট, গাড়ি চালানোর অনুমতিপত্র, আমার চাবির চেহারাও দেখিনি আমি। সব নিয়ে নেয়া হয়েছিল আমার কাছ থেকে।’

মেগান ও হ্যারি সুনির্দিষ্ট কারও নাম উল্লেখ না করে অভিযোগের তীর তুলেছেন রাজপরিবার পরিচালনা করা ‘দ্য ফার্ম’-এর বিরুদ্ধে।

অপরাহ উইনফ্রের সঙ্গে প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কেল

মেগান জানান, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে চাইলে তাতেও বাধা দেয় এই কথিত ‘ফার্ম’।

কাকে বা কাদের নিয়ে এই ‘ফার্ম’, কীভাবে পরিচালিত হয় সেটি, মেগানের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ কীভাবে উসকে দিয়েছে তারা, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে দ্য টাইমস।

এ প্রসঙ্গে উঠে আসে ‘রয়্যালস অ্যান্ড রেবেলস: দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দ্য শিখ এম্পায়ার’-এর লেখক ইতিহাসবিদ প্রিয়া আটওয়ালের গবেষণার কথা। ব্রিটেন ও দক্ষিণ এশিয়ার সাম্রাজ্য, রাজতন্ত্র ও সাংস্কৃতিক রাজনীতি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রে মেগান-হ্যারির সাক্ষাৎকার প্রচারের একদিন আগে, গত ৭ মার্চ টুইটারে নিজের মত তুলে ধরেন আটওয়াল। সেখান থেকে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দাদার দাদি- ১৮৩৭ সাল থেকে ১৯০১ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা রানি ভিক্টোরিয়ার ‘গডচিলড্রেন’ বা ‘ধর্মসন্তানদের’ কথা জানা যায়।

১৮৫০ থেকে ১৮৬০’র দশকে তৎকালীন গ্রেট ব্রিটেন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিন্ন বর্ণের এই ব্যক্তিরা রানীর ‘ধর্মসন্তান’ হিসেবে রাজপরিবারে ঠাঁই পান। অর্থাৎ ধর্মীয় বিধি অনুসারে তাদের লালনপালনের দায়িত্ব নেন রানি ভিক্টোরিয়া।

আটওয়াল বলছেন, সে সময় সেই ‘ধর্মসন্তানদের’ সঙ্গে যেমন আচরণ হতো রাজপরিবারে, ঠিক তেমনটাই হয়েছে মার্কেলের সঙ্গেও। দেড় শ বছরেও ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বৈষম্যপূর্ণ আচরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

আটওয়াল আরও বলেন, ‘রাজপরিবারের সংস্কৃতির গোড়াতেই গলদ। নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষাই তাদের জন্য সবকিছু। মুকুট ছাড়া আর কিছুই গ্রাহ্য করে না তারা। কোনোভাবে এতে আঘাত আসছে বলে মনে হলে যেকোনো মানুষকে সরিয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি কখনো।

রানী ভিক্টোরিয়ার ‘ধর্মসন্তান’ ও রাজপরিবারের নতুন সদস্য

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও ব্রিটিশ রাজতন্ত্রে বড় পরিবর্তন আসে। সারা বিশ্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের নাটকীয় সূচনাও তখনই। বিশেষ করে ১৮৫৮ সালে সাম্রাজ্যের পরিধি তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশ পর্যন্ত বিস্তার এবং এশিয়া ও আফ্রিকায় বাণিজ্য সম্প্রসারণ হয় সে সময়।

পশ্চিম আফ্রিকায় জন্ম নেয়া সারাহ ফোর্বস বোনেট্টাকে দুই বছর আটকে রাখার পর তাকে ‘উপহার’ হিসেবে দেয়া হয় রানি ভিক্টোরিয়ার প্রতিনিধি, ব্রিটিশ নৌবাহিনীর এক ক্যাপ্টেনকে। সেই শুরু। এরপর এভাবেই বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ‘ধর্মসন্তান’ হিসেবে অনেক মানুষকে দত্তক নেন রানি।

আটওয়াল জানান, ভীষণ উৎসাহের সঙ্গেই এই তরুণ-তরুণীদের নিজের ছায়ায় নিয়ে এসেছিলেন ভিক্টোরিয়া। কিন্তু আদতে তারা ছিল ব্রিটিশ রানীর ভাবমূর্তি রক্ষার, তার মাহাত্ম্য তুলে ধরার মাধ্যম মাত্র।

কুর্গের ক্ষমতাচ্যুত রাজা ও তার মেয়ে প্রিন্সেস গৌরাম্মা (১৮৫২)

এদের মধ্যে একজন ছিলেন কুর্গের প্রিন্সেস গৌরাম্মা। ভারতের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে ব্রিটিশ শাসন শুরুর পর ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ১৮৫২ সালে ১১ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে ইংল্যান্ডে পৌঁছান তিনি।

খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করা ভারতের কোনো রাজপরিবারের প্রথম সদস্য গৌরাম্মা। রানি ভিক্টোরিয়া তার ধর্মমাতা হওয়ায় দীক্ষা নেয়ার সময় তার নামের সাথে ভিক্টোরিয়া শব্দটি যোগ হয়।

‘প্রিন্সেস’ পদবি দেয়ার পাশাপাশি দামি পোশাক আর অলঙ্কারে সজ্জিত গৌরাম্মাকে রাজপরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা যেত। কিন্তু তার জীবন, বেড়ে ওঠা সবকিছুতেই কড়া নজরদারি করতেন স্বয়ং রানি।

আটওয়াল জানান, ভিক্টোরিয়ার ধর্মসন্তান হওয়ার পর জীবনে আর কোনোদিন নিজের বাবার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি গৌরাম্মা। ধীরে ধীরে মাতৃভাষা হিন্দিতে কথা বলাসহ আরো অনেক অধিকার কেড়ে নেয়া হয় তার। অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে গৌরাম্মাকে দেখা হতো ঔপনিবেশিক মানসিকতার চশমায়। পুরো বিষয়টিই ছিল যে তার আচরণ এবং পুরো মানুষটিকে কীভাবে রাজপরিবারের ভাবমূর্তি তৈরিতে কাজে লাগানো যায়।’

কিশোর বয়সে অনেকবার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেছেন গৌরাম্মা। আটওয়াল জানান, নিজেকে ভীষণ উপেক্ষিত অনুভব করেছিলেন গৌরাম্মা; যার আধুনিক সংস্করণ মেগান।

গৌরাম্মাকে নিজের ঘনিষ্ঠ মহারাজা দুলিপ সিংয়ের সাথে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া।

লাহোরের মহারাজা দুলিপ সিং (১৮৩৭-১৮৯৩)

ভারতের উত্তরাঞ্চলের পাঞ্জাবে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ১৮৫৪ সালে ১৬ বছর বয়সে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন দুলিপ। তার সন্তানদের ধর্মমাতা ছিলেন ভিক্টোরিয়া। এই ধর্মসন্তানদের অন্যতম ছিলেন, ইংল্যান্ডে নারীদের ভোটাধিকারের দাবি বিক্ষোভের সূচনা করা সোফিয়া দুলিপ সিং।

১৮৬০’র দশকে তৎকালীন আবিসিনিয়ার (বর্তমান ইথিওপিয়া) সম্রাটের ছেলে প্রিন্স আলামায়ুকে ধর্মসন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন ভিক্টোরিয়া। পরে অ্যালবার্ট ভিক্টর পোমেয়ার নামে আরেক কিশোরেরও ধর্মমাতা হন তিনি।

সারাহ ফোর্বস বোনেট্টা আর গৌরাম্মার মতোই এই দুই কিশোরও পদমর্যাদাসম্পন্ন অন্য পরিবারের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন।

এদের প্রত্যেকের শিক্ষা, আচার-আচরণ ও অন্যান্য প্রশিক্ষণসহ সব সিদ্ধান্তে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকতেন ভিক্টোরিয়া।

আটওয়াল বলেন, ‘রাজপরিবারের সদস্য এবং খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী হিসেবে তাদের প্রতি সহানুভূতি ও আত্মীয়তার মনোভাব পোষণ করতেন ভিক্টোরিয়া।’

রাজপরিবারের ভাবমূর্তি রক্ষায় কর্তৃত্বারোপ‌

ব্রিটেন ছাড়াও বিশ্বের নানা প্রান্তে যত জায়গায় ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই পুরো সাম্রাজ্যে নতুন ভাবমূর্তি তৈরি করতে এই ধর্মসন্তানদের দত্তক নিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া, বলেছেন আটওয়াল।

তিনি বলেন, ‘রাজপরিবারের জনসংযোগ তৈরির এখনকার যে চর্চা, সংবাদপত্রসহ সব গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি ও রক্ষার যে প্রবণতা, এর সবটারই গোড়াপত্তন হয়েছে ভিক্টোরিয়ার শাসনামলে।’

ঐতিহাসিক নথিপত্র থেকে জানা যায়, রাজপরিবারের ছবির অ্যালবাম তৈরির ধারণা প্রথম শুরু করেন রানি ভিক্টোরিয়া আর প্রিন্স অ্যালবার্ট।

রানি ভিক্টোরিয়ার প্রথম ধর্মসন্তান সারা ফোর্বস বোনেট্টা ও তার স্বামী জেমস ডেভিস (১৮৬২)

এসব অ্যালবামে গৌরাম্মা-বোনেট্টাসহ ভিক্টোরিয়ার ধর্মসন্তানদের ছবিও সংরক্ষিত রয়েছে; যা জনসাধারণের মধ্যে রাজতন্ত্রকে জনপ্রিয় করে তুলতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

আটওয়াল বলেন, ‘দিনে দিনে রাজপরিবারের মানমর্যাদার প্রায় পুরোটাই জনমত-নির্ভর হয়ে গেছে। তাই সময়ের সঙ্গে ভাবমূর্তি রক্ষার ব্যাপারেও তারা আরও অনড় হয়েছে। আর এভাবেই ব্রিটিশ রাজতন্ত্র, সিংহাসন ও রাজপরিবারের স্বার্থরক্ষাকে ঘিরেই যাবতীয় কার্যক্রম বাকিংহাম প্যালেসের; সাম্প্রতিককালে যা সবচেয়ে বেশি।

আর ইতিহাস বলছে, যখনই সেই আদর্শ ভাবমূর্তি রক্ষায় কোনো ধর্মসন্তান ব্যর্থ হয়েছেন কিংবা রাজপরিবারের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু করেছেন, তখনই সংবাদমাধ্যমে তাদের ‘খলনায়ক’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

১৮৭০’র দশকে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন দুলিপ সিং। পাঞ্জাব থেকে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ব্রিটিশ উপনিবেশ তৈরি, বিলাসবহুল জীবনযাপনের ওপর রানির কর্তৃত্বারোপসহ নানা কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে তার এই বিদ্রোহ। সে সময় তার ব্যাঙ্গাত্মক ছবি প্রকাশ থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যমে নানাভাবে প্রচার চালিয়ে তাকে নেতিবাচক হিসেবে তুলে ধরা হয়।

আটওয়ালের মতে, রাজপরিবারের বর্ণবাদী আচরণের সূচনা হয়েছে সে আমলেই। মেগানের ক্ষেত্রে কেবল সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে। আধুনিককালে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে রাজপরিবারের আগ্রাসী প্রবণতা বেড়েছে। প্রকট হয়েছে গণমাধ্যমের পুরোনো আচরণ।

বিংশ শতাব্দীজুড়ে ব্রিটিশ সমাজে বেড়েছে ট্যাবলয়েড পত্রিকার দৌরাত্ম্য। ১৯৯৭ সালে পাপারাজ্জিদের ধাওয়া এড়াতে গিয়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রিন্স হ্যারির মা প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুসহ সাম্প্রতিক অনেক কেলেঙ্কারি আর দুর্ঘটনায় নাম জড়িয়েছে ট্যাবলয়েড সাংবাদিকদের।

অপরাহ উইনফ্রেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে হ্যারি বলেছিলেন, মায়ের মতো স্ত্রীর সঙ্গেও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির শঙ্কায় রাজপরিবারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়ার সিদ্ধান্ত তার।

এ বিভাগের আরো খবর