বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ছেলের সন্ধানে মাটি খুঁড়ে যাচ্ছেন যে পিতা

  •    
  • ১৯ মার্চ, ২০২১ ২৩:২২

প্রায় আট কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকাজুড়ে ছেলের লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছেন কাশ্মিরের এক হতভাগ্য পিতা। সন্ত্রাসবাদীরা তার সেনা সদস্য ছেলেকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে।  

সকাল ১১টা বাজলে মাটি খোঁড়ার সরঞ্জাম নিয়ে বের হন মানজুর আহমাদ ওয়াগেই। গ্রামের অদূরে বিস্তৃত আপেল বাগান। সেখানে সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত খোঁড়াখুঁড়ি করেন তিনি। প্রায় আট কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকাজুড়ে তিনি খোঁজেন ছেলের মৃতদেহ।

গত বছরের আগস্ট মাস থেকে এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে তার।

৫৬ বছর বয়সী মানজুর ওয়াগেই ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের শোফিয়ান জেলার রেশিপোরা গ্রামের বাসিন্দা। ২০২০ সালের ২ আগস্ট অপহৃত হন তার ছেলে শাকির মানজুর। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন শাকির। ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে এসেছিলেন। এদিন কাছের সেনা ক্যাম্প থেকে ফেরার পথে নিখোঁজ হন তিনি।

শাকির মানজুর। ছবি: মানজুর ওয়াগেই

শাকিরের নিখোঁজ হওয়ার পরদিন এক বিবৃতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী জানায়, পাশের কুলগাম জেলায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে তার গাড়ি।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ধারণা করা হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদীরা অপহরণ করেছে ওই সৈনিককে। তাকে উদ্ধারে অভিযান চলছে।’

শাকির নিখোঁজ হওয়ার পাঁচ দিন পর বাড়ির কাছের একটি আপেল বাগানে তার রক্তমাখা জামা খুঁজে পান পরিবারের সদস্যরা। এই ঘটনার পরে কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শী তাদের জানান, শাকিরকে গাছে বেঁধে নির্যাতন করেছে সন্ত্রাসবাদীরা।

এরপরে আট মাস ধরে আর কোনো খোঁজ মেলেনি তার। শাকিরের পরিবার অনেকবার সেনা ও পুলিশে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। তাকে খোঁজার দায়িত্বই যেন ছেড়ে দিয়েছে তারা।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাশ্মীরের সশস্ত্র সংগঠনগুলো ছুটিতে থাকা পুলিশ ও সেনা সদস্যদের টার্গেট করছে। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে অনেককে।

শাকির মানজুর

শাকিরের নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহ পরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে। এতে শাকিরকে হত্যার দায় স্বীকার করেন নিজেকে সশস্ত্র সংগঠনের সদস্য দাবি করা এক ব্যক্তি।

অডিও ক্লিপে শাকিরকে হত্যার সাফাইও গান তিনি। বলেন, ‘আমরা ওই সেনার পরিবার ও স্বজনদের বেদনা বুঝি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে হত্যার পরে তার মরদেহ পরিবারের কাছে ফেরত দেয়া হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাই করেছি, যা ভারতীয় সেনাবাহিনী করে। তারা আমাদের অনেক মুহাজিদকে হত্যার পর লাশ অজ্ঞাত স্থানে দাফন করেছে।’

যদিও এই অডিও ক্লিপটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

গত বছর সশস্ত্র সংগঠনগুলোতে জড়িত ছিলেন এমন ১৫৮ জনের মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দেয়নি ভারতীয় সেনাবাহিনী। এর অজুহাত হিসেবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর কথা বলা হয়েছিল।

ছবিতে দেখা যায়, বেশ সুঠামদেহী ছিলেন শাকির। ২০১৬ সালে ২০ বছর বয়সেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি।

শাকিরের বাবা মানজুর ওয়াগেই বলেন, ‘লেখাপড়ার খরচ চালানোর সামর্থ্য না থাকায় আমি তাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলি।’

চাকরিজীবনের বেশিরভাগ সময় শ্রীনগর ও বান্দিপোরা জেলায় ছিলেন শাকির। কিন্তু অপহৃত হওয়ার দুদিন আগে বাড়ির কাছাকাছি বালপোরা সেনা ক্যাম্পে বদলি করা হয় তাকে।

শাকিরের চাচা বলেন, ‘ক্যাম্প থেকে তাকে বলা হয় কাছের আরেক ক্যাম্পে একটি চিঠি দিয়ে আসতে। এর পরে ঈদের ছুটিতে যেতে বলা হয় শাকিরকে।’

সন্ত্রাসবাদীরা আক্রমণ করতে পারে এই ভয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও পুলিশে কাজ করা কাশ্মিরীরা খুব কম সময়েই নিজেদের বাড়িতে আসেন। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ছিলেন শাকির। তিনি সুযোগ পেলেই বাড়িতে আসতেন। বেশির সময় স্থানীয় তরুণদের সঙ্গে ঘুড়ে বেড়াতেন। কেউ তাকে আক্রমণ করতে পারে এমন চিন্তা কখনও করেননি তিনি।

বন্ধুদের সঙ্গে শাকির মানজুর।

শাকিরের চাচা বলেন, ‘গত দুই বছরে অনেক অসুস্থ মানুষকে রক্ত দান করেছে শাকির। আমরা জানিও না ঠিক এই মুহূর্তে কত জন মানুষের শরীরে তার রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে।’

রেশিপোরা গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘শাকির এমন ছেলে ছিল, যাকে সবাই পছন্দ করত। এখনও তার সম্পর্কে যদি সামান্য তথ্য মেলে, তাহলে পুরো গ্রামের মানুষ তাকে খুঁজতে যাবে।’

আট মাস ধরে নিজের সন্তানের লাশ খুঁজে বেড়ানো মানজুর ওয়াগেই বলেন, ‘কাশ্মিরে একজন সাধারণ নাগরিকে যা করার কথা নয়, আমি তাই করে যাচ্ছি।’

পুলিশের খাতায় এখনও ‘নিখোঁজ ব্যক্তি’ হিসেবে শাকিরের নাম লেখা আছে। শোফিয়ান জেলার এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, শাকিরের অন্তর্ধান বিষয়ে এখনও তদন্ত চলছে।

পরিবারের অভিযোগ, শাকিরকে খোঁজার বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক নয় সরকার। একে দ্বিমুখী নীতি বলেও অভিহিত করেছেন তারা।

মানজুর ওয়াগেই বলেন, ‘শাকির কাশ্মিরী না হলে তার খোঁজে পুরো উপত্যকা চষে ফেলা হতো। কিন্তু আমার ছেলের জন্য তারা কিছুই করেনি।’

তিনি চান শাকিরের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি তদন্ত করুক ভারতের কেন্দ্রীয় সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিএ)।

রেশিপোরার বাসিন্দারা জানান, গ্রামের নয় জন জম্মু ও কাশ্মীরের পুলিশ বিভাগে চাকরি করেন। শাকিরই প্রথম যে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। এখন তার মতো সিদ্ধান্ত নিতে যে কেউ কয়েকবার চিন্তা করবে।

মানজুর ওয়াগেই জানান, ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে ইতোমধ্যে প্রায় সাত লাখ রুপি খরচ হয়েছে তার। কাশ্মিরের যে কোনো জায়গায় অজ্ঞাতপরিচয় লাশের খবর পেলে সেখানে ছুটে যান তিনি।

ছেলের লাশ খুঁজতে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করতে অন্য একটি লাশও খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। সেটি ছিল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক কর্মীর লাশ। ধারণা করা হচ্ছিল, অপহরণের পর তাকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসবাদীরা।

ছেলের লাশ খুঁজতে গিয়ে এ পর্যন্ত চার অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশ দেখেছেন মানজুর ওয়াগেই। তার মোবাইল ফোনে ছেলের সুদর্শন ছবির পাশাপাশি এই লাশের ছবিগুলোও জায়গা করে নিয়েছে।

ছেলেকে নিজের বাড়ির পাশে দাফন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তিনি। মানজুর বলেন, ‘দরকার হলে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত আমি ছেলেকে খুঁজে বেড়াব।’

ভারতীয় অনলাইন পোর্টাল scroll.in অবলম্বনে

এ বিভাগের আরো খবর