গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে এশিয়ার শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানির মুম্বাইয়ের বাড়ির সামনে মেলে একটি পরিত্যক্ত বিলাসবহুল গাড়ি। বিস্ফোরকবোঝাই গাড়িটি জব্দের দিন কয়েক পরই গাড়ির মালিকের মরদেহ ভেসে ওঠে মুম্বাইয়ের সমুদ্র উপকূলে। গ্রেপ্তার করা হয় মৃত ব্যক্তির পরিচিত এক পুলিশ কর্মকর্তাকে।
বিবিসি জানিয়েছে, চলমান পরিস্থিতিতে সব মিলিয়ে জন্ম নিচ্ছে একের পর এক প্রশ্ন। বাড়ছে ধোঁয়াশা।
ভারতে নরেন্দ্র মোদির সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মুকেশ আম্বানির নিরাপত্তা ঝুঁকি প্রশ্নে রহস্য উন্মোচনে মাঠে নেমেছে দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু তিন সপ্তাহে রহস্যের কিনারা হওয়ার বদলে আরও জটিল হয়েছে।
যেভাবে ঘটনার শুরু
মুম্বাই পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, আম্বানির ২৭ তলাবিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়ি ‘অ্যান্টিলিয়া’র এক নিরাপত্তারক্ষী প্রথম সবুজ রঙের স্করপিও এসইউভি পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখতে পান। খবর পেয়ে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী বিশেষজ্ঞ দলসহ ঘটনাস্থলে পৌঁছান পুলিশ কর্মকর্তারা। পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে শুরু হয় তদন্ত।
মুকেশ আম্বানির বাড়ির সামনে বিস্ফোরকবোঝাই বিলাসবহুল স্করপিও। ছবি: মুম্বাই পুলিশ
পরিত্যক্ত গাড়িটিতে মেলে আড়াই কেজি বিস্ফোরক। ইন্ডিয়া টুডেতে এক বোমা বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল বিস্ফোরক হলেও বিস্ফোরিত হলে গাড়িটি উড়ে যেত সহজেই।
গাড়ির ভেতরে মুকেশ আম্বানি ও তার স্ত্রী নিতা আম্বানিকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটি চিঠিও ছিল। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘এটা কেবল সিনেমার ট্রেলার। পরেরবার বিস্ফোরক বিস্ফোরিত হবে। তোমাদের পুরো পরিবারকে উড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা সেরে ফেলেছি।’
পাঁচটি নম্বর প্লেটও ছিল গাড়িতে।
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানির সম্পদের মূল্য ৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বেশি। তেল পরিশোধন তার প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যবসা হলেও টেলিযোগাযোগসহ অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে বড় ধরনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে আম্বানি পরিবারের।
বিস্ফোরকবোঝাই গাড়ির ব্যাপারে যা জানা গেছে
যেদিন গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়, তার আগের রাতে কারমাইকেল রোডে আম্বানির বাসভবনের বাইরের পুরো এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছে মুম্বাই পুলিশ। আশপাশের বাংলো ও অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের নিজস্ব সিসিটিভিও বাদ পড়েনি অনুসন্ধান থেকে।
দেখা গেছে, মধ্যরাতে আম্বানির বাড়ি অ্যান্টিলিয়া থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অপেক্ষা করছিল স্করপিওটি। স্থানীয় সময় রাত ১টা ৪০ মিনিটে একটি টয়োটা এসইউভি সেখানে এসে পৌঁছায়। এরপর দুটি গাড়ি একসাথে আম্বানির বাড়ির সামনে সুনসান রাস্তায় এসে দাঁড়ায় রাত আড়াইটার দিকে। স্করপিওটির পেছনে ছিল টয়োটা।
সিসিটিভি ফুটেজে বিস্ফোরকবোঝাই গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা বিশেষ সুরক্ষা পোশাক পরিহিত ব্যক্তি। ছবি: মুম্বাই পুলিশ
অ্যান্টিলার প্রবেশপথ থেকে ৫০০ মিটার দূরে স্করপিও গাড়িটি থেকে বিস্ফোরক থেকে সুরক্ষার বিশেষ পোশাক পরা এক ব্যক্তি বের হয়ে টয়োটায় ওঠেন। এরপর চলে যায় সেটি। পড়ে থাকে স্করপিওটি।
মহাসড়ক ছেড়ে শহরের কেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থিত থানের পথে থাকার সময় সিসিটিভির আওতার বাইরে চলে যায় টয়োটাটি।
বিস্ফোরকবোঝাই স্করপিওর মালিক কে?
পরিত্যক্ত স্করপিও গাড়িটির মালিক মানসুখ হিরেন নামে এক স্থানীয় ব্যবসায়ী। থানে এলাকায় গাড়ির যন্ত্রাংশের একটি দোকান আছে তার। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে তিনি জানিয়েছেন, গাড়িটি আসলে আরেক ব্যক্তির। কাজ করিয়ে টাকা না দেয়ায় মূল মালিকের কাছ থেকে গাড়িটি নিয়ে নেন তিনি।
১৭ ফেব্রুয়ারি চুরি যায় গাড়িটি। এ নিয়ে নিকটবর্তী থানায় অভিযোগও করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের পরপরই বিষয়টি নিয়ে ঝড় ওঠে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে। প্রধান সাক্ষ্য হিসেবে হিরেনের সুরক্ষা নিশ্চিতে বিরোধী দলের এক নেতা দাবি জানান ৫ মার্চ। এর কয়েক ঘণ্টা পরই মুম্বাইয়ের সমুদ্র উপকূলে হিরেনের মরদেহ ভেসে ওঠার খবর জানায় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
বিস্ফোরকবোঝাই গাড়ির মালিক মানসুখ হিরেন। ছবি: মুম্বাই পুলিশ
পুলিশ জানিয়েছে, ৪ মার্চ দোকান থেকে নিজের বাড়িতে ফেরেন হিরেন। পরিবারের সদস্যদের জানান, তাওডে নামের এক পুলিশ কর্মকর্তার ফোন পেয়ে তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন তিনি।
ওই রাতে আর বাড়ি ফেরেননি হিরেন। পরদিন তাকে নিখোঁজ বলে থানায় খবর দেন তার পরিবারের সদস্যরা।
পরে পুলিশ জানায়, রাত ৮টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন হিরেন। এর তিন ঘণ্টা পর থেকে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। যে পুলিশ কর্মকর্তার সাথে দেখা করার কথা বলেছিলেন তিনি, তার সন্ধান পাওয়া যায়নি।
হিরেনের মৃত্যুর কারণ এখনও জানা যায়নি। অপেক্ষা চলছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের। হিরেনের স্ত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে অজ্ঞাত ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশ।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার আরেক পুলিশ কর্মকর্তা
জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃত শচিন ভাজে মুম্বাই পুলিশের এলিট ক্রাইম ব্রাঞ্চের সহকারী পরিদর্শক। কারমাইকেল রোডে মালিকবিহীন গাড়ি পড়ে থাকার খবরে স্থানীয় ও জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের তিন-চার ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে পৌঁছান বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
১৩ মার্চ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দল ভাজেকে ১২ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর এ ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখায়।
পরদিন মুম্বাই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের একটি গ্যারেজে সন্ধান মেলে নিখোঁজ টয়োটা গাড়িটির, যেটিকে স্করপিওর সাথে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছিল।
মুম্বাই পুলিশের পরিদর্শক শচিন ভাজে। ছবি: পিটিআই
গোয়েন্দাদের ধারণা, অ্যান্টিলিয়ার সামনে বিস্ফোরকবোঝাই গাড়ির ঘটনার সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ভাজে। হয়তো পরিকল্পনার অংশও ছিলেন তিনি। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ভাজে।
এদিকে, হিরেনের স্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তার স্বামীর পূর্বপরিচিতও ছিলেন ভাজে। তারা দুজন মিলেই প্রায় দুই বছর ধরে স্করপিও গাড়িটি ব্যবহার করছিলেন। তাদের বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল ভাজের।
অন্যদিকে হিরেনকে চেনেন না বলে দাবি ভাজের। জানিয়েছেন, হিরেনের মৃত্যুর বিষয়েও কিছু জানেন না তিনি।
কে এই শচিন ভাজে
১৯৯০ সালে ভারতীয় পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন ভাজে। ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ হিসেবে কাজ করতেন।
শুরুতে ভালো রেকর্ড থাকলেও পুলিশের হেফাজতে ২৭ বছর বয়সী এক মুসলিম সফটওয়্যার প্রকৌশলীর মৃত্যুর ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত হন ভাজে। মুম্বাই হামলায় সম্পৃক্ত সন্দেহে খাজা ইউনুস নামের ওই যুবককে তুলে নিয়ে এসেছিল ভাজে ও তার দল। ইউনুসের মৃত্যুর দায় স্বীকার করেননি তিনি।
সাসপেন্ড থাকা অবস্থাতেই ২০০৭ সালে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি, যদিও তা গৃহীত হয়নি। সে অবস্থাতেই ২০০৮ সালে মহারাষ্ট্রের কট্টর হিন্দু্ত্ববাদী গোষ্ঠী শিব সেনায় যোগ দেন তিনি। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন না কখনোই।
গত বছরের জুনে স্থগিতাদেশ তুলে নেয়া হলে আবারও পুলিশে যোগ দেন ভাজে। তখন থেকেই ক্রাইম ব্রাঞ্চের অপরাধ অনুসন্ধান বিভাগের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।
গত সপ্তাহে দ্বিতীয়বারের মতো সাময়িক বরখাস্ত হন তিনি।
আপাতত হিরেনকে তিনি চিনতেন কি না, হিরেনের ঘাতক কে ও তাকে হত্যার কারণ কী এবং এসবের সাথে আম্বানির বাড়ির সামনে বিস্ফোরকবোঝাই গাড়ি ও আম্বানি পরিবারকে হুমকির কী সম্পর্ক, সেসব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছে ভারতের গোয়েন্দারা।